এক বই এক ফিলাডেলফিয়া
প্রসেনজিৎ সিংহ
দেখতে দেখতে আরও একটা বইমেলা এসে গেল। আমেরিকার কোনও বইমেলা দেখার সৌভাগ্য না হলেও, এদেশে এখনও পড়ার অভ্যেস অবলুপ্ত হয়নি। পার্কে, বাসে-ট্রেনে বসে পড়ে চলেছেন লোকজন এমন দৃশ্য বিরল হয়নি। পুরনো বইয়ের দোকানও তার সাক্ষ্য দেয়। এর পাশাপাশি আৱও একটা জিনিস সম্প্রতি আমার নজর কেড়েছে, সেইটেই বলি।
ফিলাডেলফিয়ার এক লাইব্রেরিতে আমার যাতায়াত আছে। সেদিন গিয়ে বিষয়টা প্রথম নজরে এল। লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখে একটা টেবিল। তাতে বিভিন্ন খোপে খোপে বেশকিছু লিফলেট বুকলেট, প্যামপ্লেট রাখা। রাজ্যের খবর সেখানে। নাটকের ওয়ার্কশপ, কুকিং ক্লাস, পড়ুয়াদের হোমওয়ার্ক করানোর বিজ্ঞাপন, সামনের স্প্রিং আর সামারে কী কী কোর্স করা যাবে এই শহরে—এইসব। একটা পুস্তিকায় চোখ আটকাল। ওয়ান বুক ওয়ান ফিলাডেলফিয়া।
উল্টে পাল্টে দেখে কৌতূহল বাড়ে। একটা বইয়ের প্রচারে আরেকটা বই। শুধু সেটুকুই নয়, এর মধ্যে রয়েছে বইটিকে কেন্দ্র করে দু’মাস ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খবর। একটা দু’টো নয়। একশোর কাছাকাছি। তার মধ্যে রয়েছে, লেখিকার সঙ্গে পাঠকদের সরাসরি মোলাকাতের অন্তত গোটা দশেক অনুষ্ঠান। ফিলাডেলফিয়া ফ্রি লাইব্রেরি বিভিন্ন শাখায় বইটি নিয়ে আলোচনাচক্রের সংখ্যা আরও বেশি। লাইব্রেরি ছাড়া এই অনুষ্ঠানগুলি হবে এলিমেন্টারি স্কুল, পার্ক, চার্চ থেকে শুরু করে পাবেও।
স্থানীয় লেখকরাও শহরের বিভিন্ন জায়গায় বসবেন বইটি নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে। তাছাড়া এই উপলক্ষ্যে তাদের লেখা গল্প প্রবন্ধ উপন্যাসের অংশ থেকেও পাঠ এবং আলোচনাকে এই সামগ্রিক উদ্যাপনের অঙ্গীভূত করা হয়েছে। লেখিকার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হবে বেশ কয়েকটি রেডিও সেন্টার থেকে।
আবার অনুষ্ঠানের বিভিন্নতা রচনায়, বইয়ের কোনও কোনও অংশে উল্লিখিত বিভিন্ন শখ, সংস্কৃতি কিংবা রন্ধনশৈলীকে কেন্দ্র করেও কোনওদিন আয়োজন করা হয়েছে রান্নাবান্নার আসর, হেয়ারস্টাইলের কর্মশালা। প্রবীণদের জন্য এবং তরুণদের জন্য ও অনুষ্ঠানের আলাদা পরিসর তৈরি করা হয়েছে। কচিকাঁচাদের জন্য, এই বই কেন্দ্রিক স্টোরিটেলিং, গানবাজনার অনুষ্ঠান। এমনকী, বইয়ের চরিত্রের জোনাকি ধরার আনন্দকে কেন্দ্র করেও অনুষ্ঠানের কথা ভাবা হয়েছে।
উদ্যাপনের এই বিভিন্নতা এবং বর্ণময়তা একটা বইকে কেন্দ্র করে— নজরকাড়ার মতোই। অথচ এই কাজটি ‘ওয়ান বুক ওয়ান ফিলাডেলফিয়া করে যাচ্ছে ২০০৩ সাল থেকে। এই দেড় দশকে ১৬ জন লেখকের বই তুলে ধরা হয়েছে এইভাবে।
ফিলাডেলফিয়ার জনবিন্যাসের গভীরে ঢুকলে বোঝা যায়, পৃথিবীর হেন কোনও দেশ নেই যেখানকার মানুষ এখানে নেই। তাদের বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতি,আচার ব্যবহারের বিভিন্নতার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করার একটা বাহন হিসাবে বইকে ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে। সেটা খুব আশার কথা। সমাজের সব শ্রেণি সমস্ত বয়সের মানুষকে টেনে আনার চেষ্টা হয়েছে। মানুষের পড়ার অভ্যেস যখন ক্রমহ্রাসমান, তখন এই ধরনের উদ্যোগ আশা জাগায় বইকী!
এবারে যে বইটি বেছে নেওয়া হয়েছে তার নাম অ্যানাদার ব্রুকলিন। আমেরিকান লেখিকা জ্যাকেলিন উডসনের এই বইটির নায়িকা অগাস্ট। টেনেসি থেকে থেকে তার বাবা এবং ভাইয়ের হাত ধরে নতুন জীবন শুরু করে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের শহরতলি বুশউইকে। সময়টা অবশ্য গ্রেট মাইগ্রেশনের। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কাল। যখন আমেরিকার দক্ষিণ অংশ থেকে আফ্রো-আমেরিকানরা দলে দলে উত্তর –পূর্ব এবং পশ্চিমে চলে আসছিলেন। বৈষম্যহীন সমাজ, জীবিকার বাড়তি সুযোগের দিকে তাকিয়ে। সেই মেয়েটির কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখার দিনগুলোতে ক্রমাগত বদলাতে থাকা চারপাশের কথা, নিজের কথা, বন্ধুদের কথাই নিজস্ব লিরিক্যাল গদ্যে তুলে ধরেছেন লেখিকা।
বইটি ট্রিলজির অংশ। (অন্য দু’টি বই : দিস ইজ দ্য রোপ—আ স্টোরি ফ্রম দ্য গ্রেট মাইগ্রেশন, ব্রাউন গার্ল ড্রিমিং) লেখিকা ইতিমধ্যে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও বহু সম্মানে ভূষিত।
এমন একটা প্রয়াসের জন্য অর্থের নিশ্চয় প্রয়োজন রয়েছে। সেই প্রয়োজন মেটাচ্ছে কারা? বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা, ফিলাডেলফিয়া কালচারাল ফান্ড, দুটি ফাউন্ডেশন। সামাজিক দায়বদ্ধতায় ধারাবাহিকতা না থাকলে এই ধরনের প্রকল্প বছরের পর বছর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া মুশকিল।
সফল লেখকদের কোনও না কোনও পর্যায়ে একটা সংগ্রাম থাকে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘সিয়েন আনোস দে সোলেদাদ’(হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড) লেখার সময় শেষ ১৮ মাস নাকি কার্যত টাইপরাইটারটি ছেড়ে ওঠেননি। নিজেকে পুড়িয়েছিলেন দশ হাজার সিগারেটের ধোঁয়ায়। আয় নেই। শুধু ব্যয়। গাড়ি, ফ্রিজ ঘরের আসবাব থেকে শুরু করে সবকিছুই একে একে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। স্ত্রী তাঁকে সেসব থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল শেষটায় প্রকাশকের কাছে উপন্যাসটা পুরোটা পাঠাতে পারলেন না পয়সার অভাবে। প্রথম অংশ পাঠালেন। এমন একটা বই তারপরে এমন আলোড়ন তুলল সে বই যে, বিশ্বের প্রায় সমস্ত প্রধান ভাষাতেই তা অনূদিত হল। চর্চা হল। আজও হচ্ছে।
আবার আজকের দিনে একটা বইকে তুলে ধরার জন্য প্রচারের ভূমিকাও কম নয়। সেই কাজটা প্রকাশক করবেন এমনটা আশা করাই যায়। হ্যারি পটারের কথাই ধরুন। এখন ব্র্যান্ড। আড়াই হাজার কোটি ডলারের ব্র্যান্ড। গোটা সাতেক বই। সিনেমা। এছাড়া রকমারি হ্যারি অনুষঙ্গের ব্যবসা। অথচ শুরুতে তো এমন ছিল না। তখন শুধুই ব্যর্থতা। বারোটি প্রকাশনা সংস্থা সম্ভাবনাময় এই বইয়ের পাণ্ডলিপি ফিরিয়ে দিয়েছিল। আবার ইউকে’র ব্লমসবেরি’র মতো প্রকাশক ঝুঁকি নিয়েছিল, সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল বলে ঠিকঠাক বিপণন করেছিল। আর তাই আজ এই সাফল্য।। রোওলিংয়ের প্রাক-পটার জীবন তো ফেসবুকে ঘুরে ফিরে ভিডিও ক্লিপ আকারে আসে হতাশদের উজ্জীবিত করার ডোপিং হিসাবে। উজ্জীবিত হওয়ার মতোই কাহিনি বটে!
ফেসবুক এখন বই প্রচারের একটা ভাল জায়গা হয়েছে। বইমেলার কিয়দংশের প্রতিফলন যেন ফেসবুকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশে বসে তা-ই বা কম কী! লেখক প্রকাশক সাধ্যমতো তুলে ধরার চেষ্টা করছেন কোনও একটি বইকে। পাঠক বা সমালোচকদের পাঠ প্রতিক্রিয়াও বইয়ের প্রচারে সহায়তা করছে খানিকটা। তবে এর সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি।
তবে বই জনপ্রিয় করার জন্য যতটা প্রয়োজন ছিল ততটা হচ্ছে কই? বাংলাভাষায় বইবিক্রির যে চিত্রটা সামনে আসে তা বেশ ঝাপসা। অথচ বাংলায় পাঠকের সংখ্যা খুব কম হওয়ার তো কথা নয়।
সব লেখকেরই একটা শুরু থাকে। বড় হয়ে ওঠার পিছনে থাকে নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার একটা ইতিহাস। ঠিক তেমনই সেই প্রয়াসকে তুলে ধরারও জন্য প্রয়োজন এমন কিছুর। আমরা কি একটা পুতুল নাচের ইতিকথা, ঢোঁড়াইচরিত মানস, গণদেবতা, কিংবা সেইসময়, চিলেকোঠার সেপাই, মানবজমিন নিয়ে এমন আয়োজনের কথা ভাবতে পারি না? অথবা একেবারে সমসাময়িকদের লেখা নিয়ে।
Leave a Reply