কোরিয়ার স্বপ্ন ভারতীয় উপমহাদেশে না দেখাই ভাল
প্রসেনজিৎ সিংহ
এ-ও এক ম্যাজিক রিয়্যালিটি।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাথার শাঁসশোভিত হেয়ারকাটে কিম জঙ-উনকে দেখা যেত দেশের উষরপ্রান্তে দু’চারজন সহযোগীর সঙ্গে। কখনও পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পর পশ্চিমি দুনিয়ার দিকে ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জের হাসিতে। হঠাৎ তিনি শান্তিকামী রাষ্ট্রনেতায় পরিণত হয়েছেন। কেন? আমেরিকার চাপে? যথেষ্ট পরিমাণ পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করে আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন, তিনিও পরমাণু অস্ত্রধর। সে কারণেই এবার শান্তির পথে প্রত্যাবর্তন?
পশ্চিমবঙ্গের এক চতুর্থাংশ লোক বাস করে উত্তর কোরিয়ায়। আয়তনে আমাদের উত্তরপ্রদেশের অর্ধেক। এ হেন একটি দেশের হুঙ্কারে সারা পৃথিবী নড়েচড়ে বসেছিল। আস্ফালন আর অননুমেয় কার্যকলাপে কিম জঙ উন সাধারণ মানুষেরও নজর কেড়েছিলেন। আর কাড়বেন না-ই বা কেন? আমেরিকার চোখে চোখ রেখে কথা বলার প্রতিস্পর্ধী সাহস আর অহঙ্কার যখন একরত্তি দেশের এক শাসকের চোখে দেখা যায় তখন দুনিয়াও তার দিকে তাকাতে বাধ্য হয়। রাতের আকাশে অনেক বড়বড় নক্ষত্রের মাঝখানে হঠাৎ উল্কার মতো তুচ্ছপিণ্ডও নজর কাড়ে।
পৃথিবী তাঁকে উপেক্ষা করতে সাহস পায়নি। বরং ভয়মিশ্রিত সম্ভ্রমেই তাকিয়েছে। অনেকে মনে মনে ভেবেছেন, ক্ষমতার দর্পে লোকটা বোধহয় নিজের শক্তি সম্বন্ধে আন্দাজ হারিয়ে ফেলেছে। খামখেয়ালি এই যুবক পৃথিবীর সামনে বড় বিপদ হয়ে আসতে চলেছে। ঠিক এমন সময়, তিনি হাত ধরে ফেললেন চিরশত্রু দক্ষিণ কোরিয়ার।
গোটা বিশ্ব হতভম্ব।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ের হাত ধরে সীমান্তের এধারে এবং ওধারে ঘুরে বেড়ালেন উত্তর কোরিয়ার প্রধান কিম জঙ উন। যৌথভাবে পরমাণুনিরস্ত্রীকরণ-এর অঙ্গীকার করলেন।
এ-ও সম্ভব? পূর্ব এশিয়ায় এমন একটা ঘটনা ঘটে গেলে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নয় কেন? ভারত এবং পাকিস্তান কেন এমন একটা পথে এগোতে পারে না?
যে বিবাদের তিক্ততা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে জিইয়ে রেখেছে একটা অনিশ্চয়তা, এবং ছায়াযুদ্ধের পরিস্থিতি, তাকে দূরে সরিয়ে রেখে কেন দুটি দেশের সরকার পারস্পরিক শান্তি আর সৌহার্দ্যের পরিবেশ তৈরি করতে চায় না বা পারে না? এই প্রশ্ন দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেই রয়েছে। যারা একই ইতিহাস, একই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বয়ে চলেছেন।
১৯৪৭ –এ দেশভাগ দেড় কোটি মানুষকে ছিন্নমূল করেছিল। অন্তত দশ লক্ষ প্রাণ দিয়েছিলেন দাঙ্গায়। প্রিয়জন হারিয়ে, সম্পদ হারিয়ে নতুন পরিবেশে নিজেদের ফের স্থিত করার যে কষ্ট, তার শরিক দুটি দেশই। ধর্মীয় নিক্তির বিচারে এই বিভাজন কাউকেই শান্তি দেয়নি। পারস্পরিক বিরোধের বিষ কখনও তীব্রতর হয়েছে, কখনও কিছুটা কমেছে। পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি কখনও। সেই ভাঙা কাচ আর জোড়া লাগেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান বিধ্বস্ত হল। তবে জাপানি উপনিবেশ থেকে মুক্ত হলেও ঠাণ্ডাযুদ্ধের শিকার হল কোরিয়া। ১৯৪৫ সালে কোরিয় উপদ্বীপ এলাকায় ‘৩৮তম সমান্তরাল’নামে বিভাজনরেখা টেনে রাশিয়া আর আমেরিকায় অধিকৃত এলাকা ভাগ করা হল। যা কার্যত উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়া। উত্তরে রাশিয়া এবং চিনের আধিপত্য। দক্ষিণে আমেরিকা। এই উপদ্বীপও নানা ওঠাপড়া আর সংঘর্ষের সাক্ষী। দুটি দেশেৱ মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল প্রায় এক দশক।
তেমন দুটি দেশ পারলে ভারত, পাকিস্তান কেন পারে না?
এমন একটা ধুয়ো প্রথম তুলল পাকিস্তানের অগ্রগণ্য পত্রিকা ডন। সন্দেহ নেই, এমন একটা প্রস্তাবের অবতারণা প্রশংসনীয়। সীমান্তের দুপারে যেসমস্ত মানুষ দেশভাগ দেখেছেন, শরিক হয়েছেন অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের, তাদের কাছে এমন একটা প্রস্তাব অবিভক্ত দেশের পুরনো দিন ফিরে আসার মতোই সুখকর। কিন্তু তা বাস্তবতার কতটা কাছাকাছি?
দুদেশের সম্পর্ক নিয়ে যারা চর্চা করেন, তারা এমন একটা প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন এমন আশা কম। জনমানসের ভাবনায় যা অনায়াসসাধ্য তা কূটনৈতিকস্তরে শতবাধার প্রাচীর দিয়ে বিচ্ছিন্ন। এত সহজে তা ভেঙে ফেলার হয়তো নয়।
তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছায় অনেকসময় কঠিন বাধাও সহজে দূর করা যায়। সেই সদিচ্ছা যে ছিল না তা নয়, ডনের পাতায় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর লাহোর বাসযাত্রার কথাও সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি পেয়েছে। তবু জিন্না-নেহরুর উচ্চাকাঙ্খায় এই উপমহাদেশে যে ঘর একদা ভেঙে গিয়েছিল, মোদী-আব্বাসি দৌত্যে তা জোড়া লাগবে এমন আশা কম।
প্রধান কারণ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক সত্তা কখনওই সামরিক ছায়া মুক্ত নয়। অন্তত গত তিন দশকে তো নয়ই। তাই রাষ্ট্রনেতা শান্তিপ্রক্রিয়ার কথা ভাবলে গোসা হয় সামরিক কর্তাদের। সন্ত্রাসে মদতদাতা হিসাবে বিশ্বব্যাপী চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই মানসিকতার বদল নেই পারতপক্ষে। কারণ তাদের অস্তিত্ব ওই ছায়াযুদ্ধের উপচ্ছায়াতেই।
আর বাইরে? চিন কিংবা রাশিয়া অথবা আমেরিকা কি খুশি হবে হঠাৎ ভারত-পাকিস্তান শান্তির পথ ধরলে? খুব জোর দিয়ে বলা যায় না। ভারত এবং পাকিস্তানকে সামনে রেখে যে পরোক্ষ রাজনীতির দাবা খেলে থাকে ওই শক্তিগুলি, তা বন্ধ হয়ে গেলে কোনও কোনও শক্তি?
একথা ঠিক, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলির সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক তা সুসংজ্ঞায়িত নয়। পাকিস্তানের ভাবমূর্তি ততটা উজ্জ্বল না হলেও ভারতকে আটকাতে চিনের মতো দেশ পাকিস্তানকে সহায়তা করবে। করে আসছে। আমেরিকা কখন কোনদিকে আগাম বোঝা শক্ত।
অতএব কোরিয়ার স্বপ্ন ভারতীয় উপমহাদেশে না দেখাই ভাল।
Leave a Reply