দায়িত্বহীন তথ্যপ্রবাহের মোকাবিলা কীভাবে করা যাবে?
প্রসেনজিৎ সিংহ
সাংবাদিকতার প্রথমপাঠ নেওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পইপই করে অধ্যাপকরা শিখিয়েছিলেন, আদালত সাংবাদিক, লবি সাংবাদিকদের ভূমিকা। বিষয়গুলো এজন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া এবং আইনসভা চলাকালীন সেই সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সতর্কতা প্রয়োজন। অনেককিছুই লেখা যায় না। এবং এর আইনি রক্ষাকবচ রয়েছে।
ঠিক তেমনই স্পর্শকাতর বিষয় এদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ নিয়ে আইনি কড়াকড়ি নেই সরাসরি। কিন্তু ভারতীয় সাংবাদিকতার ‘বিবেক’ প্রেস কাউন্সিলের কিছু পরামর্শ রয়েছে— কী করা উচিত, আর কী নয়, সে সম্বন্ধে। সরাসরি বিরত থাকার কথা না বললেও প্রতিবেদন যাতে কোনওভাবেই সাম্প্রদায়িক বিরোধে কোনও ইন্ধন না যোগায় সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে বলা হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতটুকু বিবেচনা করা দরকার। কয়েক দশক আগে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন আকাশবাণী, দূরদর্শন এবং বেসরকারি সংবাদপত্রই ছিল খবরের মাধ্যম। সরকারিস্তরে কড়াকড়ি ছিলই। ফলে বেসরকারি মালিকানাধীন সংবাদপত্রের হাত ধরেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর মানুষের গোচরে আসতো।
সত্যিই কি আসত? অধিকাংশ ক্ষেত্রেইএর উত্তর, না।
সংবাদপত্রের কর্মরত সাংবাদিকদের দায়িত্ব ছিল অপরিসীম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে দেখেছি প্রবল সাবধানতা। প্রায় ছুৎমার্গের পর্যায়ে। অনেক সময় দেখেছি, ছোটখাটো সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের খবর, যা সংবাদসংস্থাও পাঠাচ্ছে, তা নিতেও আপত্তি। যুক্তি হিসাবে অনেকে বলতেন, এমন অনেক খবরই তো প্রতিদিন ফেলে দিতে হয়। স্পর্শকাতর ওই তথ্যটুকু যদি না-ই দিলাম , তাতে খুব ক্ষতি নেই। অনেকসময় এমনও দেখেছি, ভয়াবহতা প্রশমিত করতে গোষ্ঠীসংঘর্ষের মোড়কে পরিবেশন করা হয়েছে এই ধরনের খবরকে।
ভবিষ্যতে কী হবে বলতে পারি না। তবে ভারতের সামাজিক বুনোটের বৈশিষ্ট, ধর্মীয় রীতিনীতি, ইতিহাস পরম্পরার ঘটনাবলি এতটাই স্পর্শকাতর যে তা সমগ্র জাতির জীবনে একধরনের সুপ্ত বারুদের স্তূপ হয়ে থেকে গিয়েছে। বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন সময়ে কেবল স্ফূলিঙ্গের মতো সেই স্তূপে অগ্নিসংযোগ করেছে মাত্র। সেদিক দিয়ে বিচার করলে সিপাহি বিদ্রোহ থেকে শুরু করে বিহারের দাঙ্গা, বাবরি-কাণ্ড, গোধরা-কাণ্ড, সবকিছুর পিছনেই কাজ করেছে সেই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজটি।
এই বিভেদের বীজটি মাথাব্যথার কারণ বলেই সম্প্রীতির গান গাইতে হয়। পারস্পরিক সংস্কৃতি সম্বন্ধে আগ্রহ জাগরুক না করেও নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে আলিঙ্গনের নাটক করি আমরা। বলতে দ্বিধা নেই, জাতীয়তাবাদ জাগরিত করতে কখনও ব্যবহার করা হয়েছে, কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এই বীজটিকেই। এখনও হচ্ছে । কাজেই গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব অপরিসীম, এই ধরনের খবর করার ক্ষেত্রে। কোনওভাবেই খবর যেন সেই স্ফূলিঙ্গ না হয়ে ওঠে। প্রেস কাউন্সিলের গাইডলাইনে কোনওরকম গ্রাফিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এমনকী, তা সত্য হলেও। বিশদে বলা না হলেও এর মধ্যে কোনওরকম পরিসংখ্যান, বিকৃত ছবি মোটকথা, যা দাঙ্গায় ইন্ধন যোগাতে পারে সবকিছুই পড়ে যাচ্ছে।
বলতেই হবে, পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে যে সংযত ভূমিকা এ যাবৎ পালন করে এসেছে, তা উল্লেখযোগ্য। পাশাপশি এ রাজ্যের সামগ্রিক মানসিকতায় দুই সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়টি সমাদর পেয়েছে বহুবছর ধরেই। অন্তত বাইরের রূপটি বরাবরই প্রকট।
বর্তমানে পরিপ্রেক্ষিত বদলেছে। পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক বুনোটে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আমার ধারণা, সেই পরিবর্তন যতটা পরিসংখ্যানভিত্তিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। এই পরিবর্তনটি খুব বেশিদিনের নয়। আর তা এসেছে রাজনীতির হাত ধরেই।
কিন্তু এই বিদ্বেষ-বিষ এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তা উদ্বেগজনক। শুধু তা-ই নয়, যেভাবে তা গণমাধ্যমের উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, তা ক্রমশঃই চিন্তা আরও বাড়িয়েছে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলির।
সেই উদ্বেগ আবারও স্পষ্ট হল বাদুরিয়ার ঘটনায়। এতদিন সংবাদমাধ্যমের সংযত ভূমিকায় যে খবর কখনও ছাপা হতো, কখনও হতো না (এরও ভাল মন্দ দুই-ই আছে) তা হয়ে গেল বেলাগাম। সাম্প্রতিক অতীতে এমনটি আর হয়নি, তা নয়। তবু এবারের বিশেষত্ব হল, এবার সংবাদপত্রও মাঠে নেমে এসেছিল। বলা ভাল, নামতে বাধ্য হল। এমনটা অবশ্য হওয়ারই ছিল।
কার্যত একটা বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হল। সোশ্যাল মিডিয়ার ছবি তথ্য এবং প্রতিক্রিয়ার সামনে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে উঠলেন, কেউ বিপন্ন বোধ করলেন। সেখানে এমন কিছু ছবি এবং তথ্য প্রচারিত হল, যা উস্কানিরই নামান্তর।
সোশ্যাল মিডিয়ার তাৎক্ষণিকতার বিষয়টি নেটিজেনদের হাতে। আমার পাশের বাড়িতে ঘটনা ঘটলে পরমুহূর্তেই আমি পোস্ট দিয়ে বিষয়টি ওই সোশ্যাল মিডিয়ার অন্য ব্যবহারকারীদের জানাতে পারি। সেটি ভাইরাল হলে তা নিমেষে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে সহজেই। আর এর বিষয়বস্তুর উপরেও প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবহারকারীদের হাতেই। কেউ আপত্তি জানালে কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। তবে তাতেও কিছুটা সময় লাগে। অন্যদিকে, তাৎক্ষণিকতার বিষয়টি নিউজ চ্যানেলের থাকলেও বিষয়বস্তুর উপর নিয়ন্ত্রণ কিন্তু কর্মরত সাংবাদকর্মী তথা মালিকগোষ্ঠীর হাতে। এখানে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তা সীমিত। তাছাড়া টেলিভিশনে বিষয়বস্তু ধরে রাখার মতো উপায় নেই। সেদিক দিয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকবে এই সোশ্যাল মিডিয়া।
ফলে পুরনো, নিয়ন্ত্রিত (ব্যাপক অর্থে) গণমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ার এই লড়াইয়ে সাংবাদিকতার মূল নীতিগুলিও প্রভাবিত হতে পারে। সংবাদমাধ্যমের চোখের সামনেই তাদের চৌহদ্দিতে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটেছে মসৃণ এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। অথচ প্রায় অনিয়ন্ত্রিত এবং ততটা দায়িত্বশীল না হওয়ায় এই মাধ্যমের মোকাবিলার পুরোপুরি সম্ভবও হচ্ছে না। এই বিপুল স্রোত সামাজিক পরিবর্তনকেও ত্বরাণ্বিত করছে। একে আটকানোর উপায় কী?
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তথ্যপ্রবাহকে আটকানো সম্ভব নয়। যদি না চিনের মতো একটি নিজস্ব বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। তাহলে কি চিনের মতো গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া দু’টিকেই নিজস্ব কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবতে হবে? ভারতের মতো দেশে সেটা সম্ভব নয়। পৃথিবীর বৃহত্তম এই গণতন্ত্রে সেটা অভিপ্রেতও নয়। কিন্তু দায়িত্বহীন তথ্যপ্রবাহের মোকাবিলা কীভাবে করবে সংবাদপত্র বা নিউজ চ্যানেলগুলি, তা ভাবতেই হবে। প্রেস কাউন্সিলকেও ভাবতে হবে, গণমাধ্যমগুলি কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করবে।
Leave a Reply