নৈতিকতার বিনির্মাণ কিংবা ডিজিট্যাল মিডিয়ার ধাঁধা
প্রসেনজিৎ সিংহ
যুগটাকে ডিজিটাল মিডিয়ার বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে কি তাই! মনে হয় না। কারণ, ডিজিটাল মিডিয়া (ব্লগিং, সিটিজেন জার্নালিজম, ডিজিট্যাল ফটো জার্নালিজম এবং সোশ্যাল মিডিয়া মানে ফেসবুক, টুইটার, হোয়্যাটঅ্যাপ ইত্যদি সবই এর আওতায় পড়ে) এবং ক্ল্যাসিকাল মিডিয়ার (সংবাদপত্র, টেলিভিশন রেডিও) এখন সহাবস্থান। বরং এখন যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে গণমাধ্যম চলেছে, তাকে একটা মিশ্র পরিবেশ বলা চলে।
তবে হ্যাঁ, এই পরিবেশ তীব্রগতিতে বদলাচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার নিত্যনতুন প্রযুক্তির হাত ধরে। এই পরিবর্তনের চাপ সংবাদপত্রের উপরেও রয়েছে। সেখানেও গত এক দশকে বহু পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। এখন প্রতিটি সংবাদপত্রই তার ডিজিটাল সংস্করণ বের করে। এবং সেই দুনিয়ার দস্তুর মেনেই তা ঘনঘন পরিবর্তন করতে হয়। সেখানে সংবাদপত্রের মতো দু’টি তিনটি সংস্করণে সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না।
ঠিক তেমনই সংবাদপত্র যে সংস্কৃতির উপর দাঁড়িয়েছিল, অর্থাৎ নির্ভুল বা ভ্রান্তিহীনতা, সংবাদ প্রকাশের আগে বারবার তা খুঁটিয়ে দেখা, নিরপেক্ষতা তথা বস্তুনিষ্ঠতা—সেই রীতি রেওয়াজগুলো ক্রমেই গুলিয়ে যাচ্ছে নতুন ভূমি-বাস্তবতার কারণে। তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাৎক্ষণিকতা যেন সর্বেচ্চ গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে।
মুশকিলটা সেখানেই। তড়িঘড়ির এই সাংবাদিকতা সাবেক আদর্শ এবং নীতি এবং মানকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ধরা যাক, অমুক দলের নেতা প্রতিপক্ষের কোনও এক নেতার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করলেন। সংবাদপত্র এই সংবাদটি প্রকাশের আগে সেই প্রতিপক্ষ নেতার মন্তব্য সংগ্রহ করত। তার পরে খবরটা ছাপা হত। এখন আগে ‘ধরিয়ে দাও।’ অর্থাৎ এঁর বক্তব্য আগে প্রকাশ হোক। পরে ওর বক্তব্য নেওয়া হবে। কোনও একজন পাঠক প্রথমটা পড়লেন। পরের খবরটা যখন আপলোড হল তখন তিনি কাজে ব্যস্ত। পড়া হল না।
আবার তাড়াহুড়োর কারণে একটা ভুল তথ্য বেরিয়ে গেল। সংবাদপত্রে হলে সেটা বারদুয়েক যাচাইয়ের সময় পাওয়া যায়। ফলে তা সংশোধন হয়। যদি না হল, তবে সংবাদপত্র পড়ে অনেকের সেটা নজরে পড়ল। পরদিন তার ‘ভুল সংশোধন’ প্রকাশিত হল। ডিজিটালে প্রথমে ভুল প্রকাশিত হল। ভুল ধরাও পড়ল। কিছু পরে সেটা সংশোধন করে নেওয়া হল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার দায় নেওয়া হয়না। ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ও করা হয়না। সম্ভবত সময়ের কারণেই! ফলে একদল পাঠক ভুলটাই জানলেন। একদল ঠিকটা। এর ফলে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হল, তার কী হবে!
বাড়ির পাশে ঘটনা ঘটল। মোবাইলে ছবি তুলে তরুণ তুর্কি সেটি আপলোড করলেন। আরেক ব্যক্তির সেটি পছন্দ হল না। তিনি সেটাকে ডিজিটাল কারিকুরির সাহায্য সম্পাদনা করে ছড়িয়ে দিলেন। সেটাও ভাইরাল হল। সমস্তটাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে হওয়া সম্ভব, আর তার জন্য সংবাদপত্রের বা টেলিভিশন চ্যানেলের অফিস খুলে বসতে হয় না। অতএব নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি এখানে নেই।
সিটিজেন জার্নালিস্টই হোন আর যা-ই হোন, এঁরা কেউই পেশাদার নন। সাংবাদিকতার এতদিনের অভিজ্ঞতায় অর্জিত নিয়মকানুন নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা থাকে না। কখনও কখনও তার ফল হয় মারাত্মক। কী করা উচিত, আর কী নয়, সে-ই বোধ তাঁদের কাছে প্রত্যাশিতও নয়। কারণ, সাধারণ নৈতিকতা আর সাংবাদিকতার নৈতিকতা এক জিনিস নয়। বিশ্বজুড়ে যেখানে সাংবাদিকরা কাজ হারাচ্ছেন সেখানে এই প্রশ্নটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
তবে স্বচ্ছতার প্রশ্নটি আগের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। একজন নাগরিক ইচ্ছে করলেই স্বাধীনভাবে সত্যমিথ্যা জানতে পারেন। পেতে পারেন তাঁর প্রয়োজনীয় তথ্য। এমনকী মিডিয়া যেখানে শক্তিশালী সেখানে প্রায় কারও রেয়াত নেই।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা দেওয়ার পরেই মিডিয়া উঠেপড়ে লেগে যায়, বক্তব্যে তিনি কোন কোন ভুল তথ্য দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তা দেওয়া হয়। কখনও কখনও তাঁর ভাষণ চলাকালীনও। সেটা সাংবাদিকতার পক্ষে খুবই স্বাস্থ্যকর।
কিন্তু সংবাদপত্র অফিসে সম্পাদক থেকে শিক্ষানবীশ সাংবাদিক পর্যন্ত একই ব্যবস্থা, একই নীতির শরিক। তথ্যের ব্যবহার সেখানে নিয়ন্ত্রিত এবং পরীক্ষানিরীক্ষার আতসকাচের তলায় আনা যায়। কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়ার এই জগতে শুধু সংবাদপত্রই সংবাদ দেয় না, সাংবাদিক খবর পাওয়ার আগেই অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া কোনও ব্যক্তি ঘটনা দুর্ঘটনার ছবি সমেত লাইভ দিয়ে দিচ্ছেন ফেসবুকে। আর তারই প্রেক্ষিতে কোনও এক নেতা টুইট করছেন। সাংবাদিকেরাও অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রথাগত রিপোর্ট তৈরির আগেপরে টুইট করছেন। দু’এক কথায় মন্তব্য করছেন। পাল্টা মন্তব্য ছুড়ছেন আরেক সাংবাদিক।
অলিগলিতে খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে এভাবেই। সত্য-মিথ্যা-অর্ধসত্য-আংশিক সত্য সবই রয়েছে। শুধু নেই যেটা, সেটা হল নিয়ন্ত্রণ আর দায়িত্ব।
ডিজিটাল মিডিয়ার সাংবাদিকতার সেই অর্থে কোনও নৈতিকতা এবং আদর্শ তৈরি হয়নি। পথ দেখানোর জন্য নেই প্রেস কাউন্সিলের মতো কোনও সংস্থা। একে মিডিয়াদূষণ বলা যায় কি না, বিশেষজ্ঞেরা বলবেন। তবে গণমাধ্যমের ফরম্যাট বদলাচ্ছে। তার সঙ্গে তালমিলিয়েই চলতে হবে। কারণ প্রযুক্তির সঙ্গে অসম লড়াইয়ে জেতা যাবে না এটা হয়তো বোঝা হয়েছে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের। তবে কি এর জন্য নৈতিকতার প্রথাগত পথ নতুন করে তৈরি করতে হবে? উত্তর দেবে সময়।
Leave a Reply