বাংলাভাষার কাগজের হাল এমন কেন?
প্রসেনজিৎ সিংহ
আঞ্চলিক ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের শিরোপা এই বাংলারই একটি খবরের কাগজের। কিন্তু ট্র্যাজেডি হল, বাংলাভাষায় খবরের কাগজ পড়া লোকের সংখ্যা কিন্তু সেভাবে বাড়ছে না। এ ব্যাপারে ভারতের অনেকগুলি ভাষার চেয়ে বাংলা পিছিয়ে রয়েছে। ভাষাভিত্তিক সংবাদপত্র পাঠের বিচারে বাংলা বৃদ্ধির হারে নয়-এ। তার আগে হিন্দি, ইংরেজি তো বটেই, রয়েছে তামিল, তেলুগু, মালয়ালম, কন্নড়, এমনকী, মরাঠী ,পাঞ্জাবিও। তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে অডিট ব্যুরো অফ সার্কুলেশন একথা জানিয়েছিল, এবছরের মে মাসে। তারা এ-ও জানিয়েছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলিতেও প্রিন্ট মিডিয়ার বৃদ্ধি কিন্তু কমেনি। সেটা কম আশার কথা নয়। তাহলে বাংলাভাষার খবরের কাগজের হাল এমন কেন?
ভারতে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত শুরু হওয়ার পর থেকেই যে আশঙ্কা চলে আসছিল, প্রিন্ট মিডিয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে। বাস্তবে কিন্তু তা ঘটেনি। অবশ্য মুদ্রণ মাধ্যমে সাংবাদিকতার রীতি রেওয়াজগুলোর পরিবর্তন হয়েছে। সংবাদপত্রে সাধারণ অথচ আনকোরা খবর পাওয়া এখন মুশকিল। কারণ, দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের হাতেই এখন তাৎক্ষণিকতার চাবিকাঠি। তা সত্ত্বেও কিছু ‘ব্রেকিং নিউজ’ সংবাদপত্রগুলির হাতেই এখনও আসছে।
তবে সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে খবরের অপেক্ষায় থাকার রেওয়াজ এখন ভুলতে বসেছে বাঙালি। আগেরদিনই জানা হয়ে যাচ্ছে সব। এখন তারা অনেক স্মার্ট। বিশেষত নতুন প্রজন্ম। মোবাইল ফোন প্ল্যাটফর্মে ইন্টারনেটের সুবিধা এসে যাওয়ায় খেলার নিয়ম বদলেছে। পছন্দসই খবরের বন্যা বইছে ইন্টারনেটে। রাতে শুতে যাওয়ার আগে আর ঘুম থেকে উঠে ‘আলটিমেট গ্যাজেট’ মোবাইলে চোখ বোলাচ্ছে এই প্রজন্ম। কাগজওয়ালার অপেক্ষায় থাকার দিন ছোট হয়ে আসছে। যদিও এই নস্ট্যালজিক অভ্যেসটুকু বাঙালি এখনই ছাড়তে রাজি নয়। বাঙালির সে স্মৃতিকাতরতা প্রসঙ্গে বাবা-কাকাদের কথা আগে বলতে হবে।
তবে একথা ঠিক, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রে যে পরিবর্তন এসেছে, তা চোখে পড়ার মতো। বাংলা কাগজগুলির প্রায় প্রতিটিই এখন ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মে। সেখানেও প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ পাঠকের হিট পাওয়া যাচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই তাদের বড় একটা অংশই প্রবাসী বাঙালি। এই যে কয়েকলক্ষ নতুন পাঠক এলেন, তাতে বাংলা সংবাদপত্রগুলির পাঠকসংখ্যা বাড়ল বই কমল না। ফলে ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপনের সুবাদে কিছুটা অর্থেরও মুখ নিশ্চয় দেখছে সংবাদপত্রগুলি। তবে কতটা, বা তা দিয়ে সংবাদপত্র চালানো যাবে কি না, সর্বোপরি গেলে সেই সংবাদপত্রের পরিকাঠামো কেমন হবে, কত মানুষ সেখানে চাকরি করতে পারবেন, তা পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।
এরই পাশাপাশি, দেশে বিদেশে বড়বড় সংবাদপত্রগুলি ইন্টারনেটেও গ্রাহক নেওয়া শুরু করেছে। অর্থাৎ বিনি পয়সায় আপনি সবটুকু পড়তে পারবেন না। এ দেশেও এবার তেমনই ব্যবস্থা চালু হবে বলে আশা করা যায়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ম্যাগাজিনের কিন্তু ইন্টারনেটে গ্রাহক হওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে অন্তর্জালকে কাজে লাগিয়ে সংবাদপত্রের ব্যবসা পরিপুষ্ট হচ্ছে। পুরনো বা গতানুগতিক সংবাদপত্র ব্যবসার ধরনধারন বদলে যাচ্ছে। একটা নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি সংবাদপত্রগোষ্ঠীর হাতে থাকছে না।
আবার কাজ এবং ইন্টারনেটের পারস্পরিক নির্ভরতাও তৈরি হচ্ছে। কাগজে বিভিন্ন সোশ্যালমিডিয়ার উদ্ধৃতি দিয়েও সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে। কোনও কোনও সংবাদপত্রে সোশ্যাল মিডিয়া রীতিমতো ‘বিটে’র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। কারণ, অনেকসময় দেখা যাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়া টেলিভিশনের চেয়েও বেশি ‘হ্যাপেনিং’। সেখানেই তথাকথিত ‘ হুজ-হু’রা বেশি সক্রিয় থাকছেন। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-পাল্টা প্রতিক্রিয়া সেখানেই জানাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী থেকে ফিল্মস্টার সকলের টুইটার হ্যান্ডল এখন সাংবাদিকদের অবশ্য নজরদারির তালিকায় পড়ে। যেহেতু সেটা সরাসরি তাঁরা বা তাঁদের অনুমোদিত কেউ লিখছেন, সেখানে তাই বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও অনেকে আশ্বস্ত হচ্ছেন। উল্টোটাও হচ্ছে। মানে, খবরের কাগজের খবর নিয়েই সকাল থেকে ২৪ ঘণ্টার চ্যানেলে তোলপাড় হচ্ছে এমনও দেখা যায়। অর্থাৎ দু’টি মাধ্যম প্রতিযোগিতার পাশাপাশি পরস্পরের পরিপূরকও হয়ে উঠছে।
বিজ্ঞাপনের মোট পরিমাণ হয়তো বেড়েছে। কিন্তু তার একটা বড় অংশ অনেকদিনই বৈদ্যুতিন মাধ্যমমুখী। সংবাদপত্রগুলির আর্থিক সংকটের শুরু সেখান থেকেই। এখন আবার অন্তর্জালের বিজ্ঞাপনও জনপ্রিয় হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম খরচে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছনোর একটা রাস্তা খুলে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে। কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণ কতটা সংবাদপত্রের হাতে থাকছে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তেমনই আশার কথা, অন্তর্জালে পাঠকসংখ্যা বেড়েই চলেছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। সেই সম্ভাবনা আগামিদিনে সংবাদপত্রকে ভালভাবে বেঁচে থাকার রসদ কতটা জোগাতে পারবে, তা দেখার বিষয়।
বাংলা খবরের কাগজগুলির পাঠক তাহলে সেভাবে বাড়ছে না কেন? প্রশ্নটা মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দেয়। আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, শিক্ষার হার, জীবনযাত্রার মান বাড়ার সঙ্গে বাঙালিবাড়িতে ইংরেজি পঠনপাঠনকে প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে বাংলাকে দূরে সরিয়েই। শিশুকিশোরদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আন্তর্জাতিক ভাষায় শিক্ষাদান এখন বেশি গ্রহণীয়। পৃথিবীতে এখনও ধুকপুক করে বেঁচে থাকা সাতহাজার ভাষার অর্ধেকও পরের দশকে থাকবে না বলে অনুমান ভাষাবিজ্ঞানীদের। প্রতি ১৪ দিনে এখন পৃথিবী থেকে একটি ভাষা মুছে যাচ্ছে।
যদিও সেই তালিকায় বাংলার এখনই ঢোকার সম্ভাবনা নেই। বাংলাভাষার সেই দুর্দিন আসেনি। বরং ফেসবুক টুইটারে বাংলা পোস্টের সংখ্যা বাড়ছে। সেখানে সাহিত্য চর্চাও ঊর্ধ্বমুখী। পৃথিবীতে জনসংখ্যার বিচারে বাংলা ভাষাভাষীরা রয়েছেন সাত নম্বরে। ভারত, বাংলাদেশে, প্রবাসী মিলিয়ে প্রায় ২০ কোটি মানুষ বাংলা বলেন। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষীদের বড় অংশের কাছেই খবরের কাগজ কেনাটা বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু শহুরে বাঙালির মধ্যেও যদি বাংলা কাগজ ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, তবে তা সুখের কথা নয়।
Leave a Reply