বাংলা সাংবাদিকতা কি আপসের রাস্তায় হাঁটছে?
বাংলা সাংবাদিকতা কি আপসের রাস্তায় হাঁটছে?
প্রসেনজিৎ সিংহ
ফিলাডেলফিয়া শহরে গ্রাফিটি’র বেশ চল। আমি শিল্পবোদ্ধা নই। গ্রাফিটির মধ্যে নেগেটিভ একটা ব্যাপার আছে, আমি সেটা ব্যতিরেকেই বলছি। কাজেই একে ম্যুরাল বা ফ্রেস্কো বলতে হবে কি না, ঠিক বলতে পারি না। যাইহোক, সেগুলো কোনওটাই খুব ছোটখাটো নয়। বিশাল দেওয়ালে বড়বড় ছবি। প্রায় প্রতিটি ছবিই কিছু একটা বার্তা বহন করছে , দেখলেই বোঝা যায়। আমেরিকার পুরনো শহরগুলোর মধ্যে একটি এই ফিলাডেলফিয়ার সব কথা জানি না। তবে শ্রদ্ধার ভাবটা রয়েছে। যে কথা বলার জন্য এই দেওয়ালচিত্রের প্রসঙ্গের অবতারণা, তিনি এড ব্র্যাডলি। এডওয়ার্ড রুডলফ ব্র্যাডলি জুনিয়র।
ব্র্যাডলিকে মানুষ চেনে তাঁর বিখ্যাত শো ‘সিক্সটি মিনিটস’-এর জন্য। তবে তাঁর মুকুটে আরও পালক রয়েছে। তিনিই ছিলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হোয়াইট-হাউস করসপন্ডেন্ট। সেটা নিক্সনের সময়। ভিয়েতনাম যুদ্ধও কভার করেছেন। কম্বোডিয়ার যুদ্ধে শেল ফেটে পিঠে এবং হাতে আঘাত পান। সিবিএস নিউজের অ্যাঙ্করিংও করেছেন। তবে টানা ২৬ বছর ‘সিক্সটি মিনিটস’ তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে। ২৬টা এমি অ্যাওয়ার্ডস তাঁর ঝুলিতে। যাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নীল আর্মস্ট্রং, বব ডিলান, মাইকেল জর্ডন, মাইকেল জ্যাকসন।
শুনলাম এই শহর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে চায় গ্রাফিটির মাধ্যমেই। এই শহরের কৃষ্টির সঙ্গে গ্রাফিটি মিলেমিশে রয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওঁকে স্মরণ করতে গ্রাফিটির চিন্তাটা বেশ ভাল লেগেছে। জায়গা নির্বাচন হয়েছে। তবে আঁকা শুরু হয়নি। ক’দিন পরে আনুষ্ঠানিকভাবে তা হওয়ার কথা।
ব্র্যাডলি এই শহরেরই বাসিন্দা ছিলেন। ছোটবেলা এখানে কাটলেও পরে তিনি ওয়াশিংটন ডিসি’তে পাকাপাকিভাবে চলে যান। ২০০৬ সালে মারা যান। মৃত্যুর এগারো বছর পরে এমন একটা উদ্যোগ বলে দেয় মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে।
বলা হয় সংবাদ পচনশীল। আজ মুচমুচে, কাল ঠোঙা। আজ সেনসেশন, কাল শুকনো তথ্য। এ হেন ‘কমোডিটি’র কারবারিদের আর কে মনে রাখে! গুণীজনরা বলেন, সাহিত্যিক অমর হতে পারেন, কিন্তু সাংবাদিকের অমরত্ব কষ্টকল্পনা। সময় তাঁকে মুছে দেয় খবরেরই সঙ্গে।
তবু ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির সাংবাদিক কিংবা বফর্স তথ্য ফাঁস করা সাংবাদিককে ইতিহাস মনে রাখে। কেস স্টাডি হিসাবে হলেও। কিন্তু তেমনভাবে ক’জন সাংবাদিক আর জনমানসে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেন! প্রতিবছর যাঁরা পুলিৎজার পান তাঁদেরই বা ক’জনকে মানুষ মনে রাখে?
কিন্তু পশ্চিমে এই মনে রাখার চর্চার একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে। একটা আঁটোসাঁটো সম্মিলিত রূপ রয়েছে। স্মৃতিচর্চাতেও অর্থ লাগে। সেই অর্থই বা আসবে কোত্থেকে, সে প্রশ্নও রয়েছে। তবু মনে হয়, বাংলা সাংবাদিকতা যাঁদের হাত ধরে এতদূর এল তাঁদের মনে রাখার একটা উত্তরদায়িত্ব রয়েছে।
বাংলা সাংবাদিকতার দিকপালদের আমরা ক’জন মনে রেখেছি? বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ হাল আমলের বরুণ সেনগুপ্ত এইরকম কয়েকটি নাম ছাড়া খুব বেশি কারও কথা মনে রাখেনি বাঙালি। সেভাবে বললে হয়তো দেখা যাবে নামটুকুই মনে রেখেছে। তাঁদের কীর্তির কথা সেভাবে মনে থাকেনি।
এই প্রসঙ্গে যে কথাটা আজকাল অনেক সাংবাদিকই বলছেন, তা হল জনমানসে এই পেশাটার প্রতি একটা সামগ্রিক অশ্রদ্ধা বেড়ে চলেছে। বিশেষত বাংলায়।
বাংলা সাংবাদিকতা কি আপসের রাস্তায় হাঁটছে? ক্ষমতা, অর্থের বিপুল বিক্রমের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার প্রতিস্পর্ধী শক্তি বাংলা সাংবাদিকতা থেকে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে? সরকারি সুযোগ সুবিধা কিংবা বেসরকারি সংস্থার ফ্ল্যাট জমি এসবের চক্করে অনেক সাংবাদিক মুখ পুড়িয়েছেন। এই মুহূর্তে এমন অনেক সাংবাদিক রয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে এমন কথা শোনা যাচ্ছে।
সরকারি অনুগ্রহ কিংবা রাজনৈতিক দলের অনুগ্রহ থেকে সসম্মানে দূরে থাকতে না পারলে সেই অনুগ্রহই কারও কারও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে পেশার ক্ষেত্রে। স্পষ্টভাবে যা বলা উচিত, দ্ব্যর্থহীনভাষায় যা লেখা উচিত, তা লিখতে হাত কেঁপে যাবে। তখন প্রতিবেদনকে ভজনা মনে হবে।
সাংবাদিকতার আদর্শকে সবার উপরে স্থান দেওয়ার মানসিকতা যে সংবাদপত্র বা চ্যানেলগুলির থাকে না, সেটা পাঠক-শ্রোতামাত্রেই বুঝতে পারছেন। রয়েছে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার দায়। বাণিজ্যিকভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মতো অনেক প্রশ্নেই নমনীয় হতে হয় সংবাদ চ্যানেল বা সংবাদপত্রগোষ্ঠীকে, একথা নতুন নয়। তার প্রতিফলন সংবাদে প্রতিফলিত হয়। সাধারণ পাঠক-দর্শক তা খুব সহজেই বুঝতে পারেন। তা নিয়ে কাটাছেঁড়াও যে চলে তা বলে দিতে হয় না। অর্থাৎ বলতে চাইছি, পক্ষপাত পক্ষপাতই। খোলামনে তা যদি বিচার না করা যায় তবে মুশকিল। নিরপেক্ষতা বা বস্তুনিষ্ঠতা আপেক্ষিক ব্যাপার বলে শুধু পার পাওয়া যাবে না। পাঠক-শ্রোতারও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ, সেটা মনে রাখতে হবে। সেটা মনে রাখতে না পেরেই বাংলা সাংবাদিকতা ক্রমাগত নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে মারতে চলেছে। এর শেষ কোথায় জানা নেই।
ব্যক্তিগত স্বার্থ বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সামলাতে গিয়ে সাংবাদিকতার স্বার্থ যে ভাবে জলাঞ্জলি যাচ্ছে, তাতে জনমানসে সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জিনিসটা ক্রমশ হারাতেই থাকবে। সাংবাদিকতার এই প্রজন্মকেও ভাবতে হবে, উজ্জ্বল উত্তরাধিকার সঠিকভাবে বহন করা হল কি না, কিংবা আগামিদিনের জন্য কোন আদর্শের নিদর্শন আমরা ছেড়ে যাচ্ছি।
Bhison guruttopurno lekha