সাংবাদিকতা এবং হোমিওপ্যাথির গুলি
শুনেছি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় পোটেন্সির মাহাত্ম্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যত লঘু করা হবে ততই শক্তি বৃদ্ধি পাবে। হানিম্যানের দিব্যি, আমার হোমিওপ্যাথি জ্ঞান শূন্য। কাজেই ভুল হলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন। অর্বাচীনের প্রলাপ ভেবে উড়িয়ে দিলেও কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। পোটেন্সির কথাটা মনে এল সাংবাদিকতার সাম্প্রতিক ধরনধারণ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে। কেন সেটা বলি।
নব্বইয়ের দশকের আগে, সাংবাদিকরা সব অর্থেই প্রান্তিক ছিলেন। সংখ্যায় কম ছিলেন। তাদের মাইনে কম (এখন বাড়বাড়ন্ত বলা যায় না অবশ্য) ছিল। আর সামনে ছিল আদর্শের নেশা। আপস করলে পাপোশ হতে হয়, এই জ্ঞানটি ছিল টনটনে। সে কারণেই তাঁরা আজকের তুলনায় শ্রদ্ধেয় ছিলেন সমাজের চোখে।
প্রযুক্তির হাত ধরে মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত শুরু হল নতুন শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে। কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাত ধরে জাতীয়স্তরে বেসরকারি টিভি চ্যানেল শুরু হল। সেটা দেশের জাতীয় জীবনে ছিল একটা বিরাট ঘটনা। দূরদর্শনের বাঁধা নিয়মের নিয়মনিষ্ঠ সম্প্রচারের যে ক্ষমতা সীমিত, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল। প্রচারের একচেটিয়া স্বত্ত্বের অচলায়তনে খোলা হাওয়া বইয়ে দিল বেসরকারি চ্যানেলগুলি। বিশেষত বেসরকারি চ্যানেলের সংবাদ পরিবেশনা এবং তাৎক্ষণিকতার প্রতিযোগিতা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল।
একের পর এক রহস্য উদ্ঘাটন, দুর্নীতি ফাঁস করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার বিভিন্ন ভাবে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গী হল দেশের দর্শক। দেখতে দেখতে আঞ্চলিক ভাষাতেও একের পর এক চ্যানেল আত্মপ্রকাশ করল। বলতে কী, সেসময় সাংবাদিক-সহ চ্যানেল সফলভাবে চালাতে গেলে যত সংখ্যক পেশাদারের প্রয়োজন ছিল তার জোগান ছিল না। খানিকটা অপ্রস্তুত অবস্থাতেই পথ চলা শুরু করল চ্যানেলগুলি। তার ফল খুব ভাল হল না।
পরবর্তীকালে ছোট চ্যানেল থেকে শুরু করে জাতীয় চ্যানেলের নীতিনির্ধারকেরা সাংবাদিকতার মূল নীতি ভুলতে বসলেন নানা চাপে। শুধু চাপ বললে আংশিক সত্য বলা হয়। কখনো সখনও সংবাদপত্র বা চ্যানেলকে ব্যবহারও করা হয়েছে মালিকপক্ষের সুযোগ সুবিধা আদায়ে। মালিকপক্ষের সঙ্গে শাসকদলের সমঝোতার ফলে সাংবাদিকদের একাংশ প্যাঁচে পড়ে এবং চাকরি রক্ষার তাগিদে বশংবদ বেতনভূকে পরিণত হলেন। ফাঁকতালে কেউ কেউ ব্যক্তিগত স্তরে কিছুটা গুছিয়েও নিলেন।
চ্যানেলে চ্যানেলে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে চারপাশে বেশ কিছু সাংবাদিকতা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। সেগুলি থেকে কিছু কিছু চাকরি যে হল না তা নয়, তবে বিষয় হল এগুলি বেশিরভাগই অপেশাদার পরিকাঠামোহীন মুনাফালোভী প্রতিষ্ঠান, যাদের পক্ষে পেশাদার তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।
চ্যানেলগুলি যে সময় ২৪ ঘণ্টার চ্যানেলে পরিণত হতে লাগল, সেসময় দেখা গেল সারাদিন সামাল দেওয়ার মতো কনটেন্ট তৈরি করা যাচ্ছে না। বিষয়বস্তুর চর্বিতচর্বনে একঘেয়ে হয়ে উঠল। সেইসময় হার্ডনিউজকে আরও বিনোদনমূলক করার প্রয়াস শুরু। আর এখন তো নিউজ ইনফোটেনমেন্টই। নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা এল ক্ষেত্রটিতে। সকলেই তৈরি হয়ে এল তা নয়। অনেকেই এল মুখ দেখানোর বাসনায়। রাতারাতি জনপ্রিয়তালাভের অভিলাষ পূর্ণ করার বাসনায়।
দিনের ২৪টি ঘণ্টা সংবাদে পূরণ করতে হলে যত সংবাদ প্রয়োজন বা যত ফুটেজ প্রয়োজন, তার জোগান দেওয়া হয়তো অসম্ভব নয়। কিন্তু পেশাদারিত্ব কিনতে গেলে যতটা অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়, সংবাদ পরিবেশনের মান যে স্তরে উন্নীত করতে হয়, সেই জায়গাটা নিশ্চিত করা হচ্ছে কি? হাতে ভিডিওক্যাম থাকলেই তিনি রিপোর্টার হয়ে ওঠেন না। আবার যিনি কষ্ট করে নিজের একটা জায়গা তৈরি করেছেন, তিনি অত সহজে ধরা দেন না। ফলে দু-একটি প্রথমসারির চ্যানেল ছাড়া অন্যত্র পেশাদার কর্মীর অভাব রয়েছে।
সাংবাদিকতা সকলের জন্য— এই মহানবার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ এগিয়ে এলেন এই মহানব্রত নিয়ে। সকলেই সাংবাদিক হলেন। সাংবাদিকতাকে সকলের হাতের মুঠোয় এনে দিতে কখনও সিটিজেন জার্নালিজম আমদানি করা হয়েছে। এত খানিক স্বাদ বদলও হল। আবার কম খরচে সময়ও ভরে গেল।
সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে একটা চালু ঠাট্টা ছিল একসময়, দশটা শকুন মরে নাকি একটা সাংবাদিক হয়। শকুনের যেমন ভাগাড়ের দিকে নজর, তেমনই সাংবাদিকও মৃত্যু, দুর্ঘটনা, কেচ্ছার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তা শকুনের সংখ্যা যেভাবে কমছে আর সাংবাদিকের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ওই আনুপাতিক হিসেবে সামাল দেওয়া যাবে না বলেই মনে হয়। নতুন উপমা খুঁজতে হবে।
যে কথা শুরুতে বলেছিলাম, পোটেন্সি বৃদ্ধির সূত্র, তাতেই ফিরে আসি। ঠাট্টা করে অনেকে বলেন পোটেন্সির এই সূত্র সত্য হলে আটলান্টিকের এপার থেকে তিনটে গ্লোবিউল ছেড়ে দিলে ওপারে আমেরিকায় এক আঁজলা জল তুলে খেলেই রোগ নিরাময় হতে পারে।
সাংবাদিকতার এই লঘুকরণে পেশাটির লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। মানসম্ভ্রম তো বাড়েইনি।
ঠিক সেরকম শুধু প্রচুর সংখ্যায় ছেলেমেয়ে এই পেশায় এসে গেলেই এর উন্নয়ন সম্ভব নয়। যথাযথ শিক্ষা ছাড়া, প্রশিক্ষণ ছাড়া তাদের সঠিক পথে চালিত করা সম্ভব নয়। গণমাধ্যম যে এখনও শক্তিশালী অস্ত্র, তা নেতা-মন্ত্রী-সান্ত্রী থেকে জনগণ সকলেই জানেন। কিন্তু এ-ও ঠিক, এই অস্ত্রের ট্রিগারে যার আঙুল থাকবে, তাঁকে যথেষ্ট বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন হতেই হবে।
Leave a Reply