সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতার সমপর্ণবিন্দুটি কোথায়
প্রসেনজিৎ সিংহ
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মুখটা এখন অফ ফোকাসে তোলা ছবির মতো। অস্পষ্ট। ব্লার্ড। যারা চতুর্থ স্তম্ভ নামে ক্যামেরাটাকে ধরে রয়েছেন তাদের হাত কাঁপছে। কেন কাঁপছে? সে কি হাতের স্নায়বিক দৌর্বল্য নাকি হাতের বাইরে অন্য কোনও হাতের বাধাদান কিংবা বলপ্রয়োগ, নাকি দু’টোই, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু মোদ্দা বিষয় হল, ছবি আর ঠিকঠাক উঠছে না। বস্তুনিষ্ঠ সত্যের অবয়ব অস্পষ্ট, কোথাও ঘোলাটে, কোথাও একপেশে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্বে অল্পস্বল্প ভাবনাচিন্তা যে হচ্ছে না, তা নয়। কাদের মাধ্যমে, কী উপায়ে গণমাধ্যমের চোখে ছানি পড়ে, তার মোটামুটি ছকগুলোও নিয়েও কমবেশি চর্চা চলছে। ক্ষমতার সাধনা করছেন যাঁরা, কিংবা অপরাধকে লুকোবার নিরন্তর প্রয়াস যাদের রয়েছে, তাদের মধ্যে কেবল বুদ্ধিমান এবং কুশলীরাই সত্যের মুখ ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ তাঁরা জানেন, গণমাধ্যমের শক্তি এবং সম্ভাবনা।
গণমাধ্যমের দূষণ এ যুগে কর্পোরেট এবং রাজনৈতিক মহলের প্রভাবে। তথ্য-স্বাধীনতার মুখ এরা ঢেকে দেন নিজেদের স্বার্থেই। তবে সারা বিশ্বে একই ছকে গণমাধ্যমকে দূষিত করার চেষ্টা চলছে এমনটা নয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মডেল। তবে নজর করলে দেখা যাবে, গত এক দশকে সারা বিশ্বেই গণমাধ্যমের মালিকানার ছকটির দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। যেটা লক্ষ্যণীয়, তা হল অনেক কর্পোরেট গোষ্ঠীর হাত থেকে বৃহৎ এবং মুষ্টিমেয় কয়েকটি কর্পোরেট গোষ্ঠীর হাতে গণমাধ্যমগুলির মালিকানা তথা পরিচালন ক্ষমতা এসে যাওয়া।
গণমাধ্যম আর পাঁচটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতোই মুনাফাপ্রত্যাশী। কিন্তু ডাক্তারের যেমন অর্থ রোজগারই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়, সংবাদমাধ্যমেরও দায়বদ্ধতা জলাঞ্জলি দিয়ে মুনাফাই একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা এবং পাঠকের প্রতি আরও সঠিকভাবে বললে তথ্যের প্রতি, সত্যের প্রতি, সাংবাদিকের বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধতা কোনওদিনই অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে না। তাহলে সেটা আর সাংবাদিকতা থাকে না।
দায়বদ্ধতার সমর্পণবিন্দুটি ঠিক কোথায় আজকাল অনেকই তা নিয়ে সন্দিহান। একজন সাংবাদিক কার প্রতি দায়বদ্ধ? তথ্যের প্রতি? পাঠকের প্রতি না, তাঁর মালিক, যিনি অন্ন দেন তাঁর প্রতি? অনেক সাংবাদিককে বলতে শুনেছি, আপনি আমাকে মাইনে দেন না। আমার যদি কোনও রকম দায়বদ্ধতা থেকে থাকে, তবে যিনি মাস গেলে আমার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে তাঁর প্রতি। কথাটা ভেবে দেখলে একদিক থেকে ভুল নয়। সেটাই হওয়া উচিত। তবে প্রশ্ন যদি হয়, এটাই চূড়ান্ত কি না, তাহলে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। সাংবাদিকতাকে মনিব আর বেতনভূক সম্পর্কের তুচ্ছ লেনদেনের গণ্ডি দিয়ে বেঁধে ফেললে এই পেশার অবমাননা করা হয়। সেই অপমানের ভাগী হতে হয় দু’পক্ষকেই।
অবশ্য এই প্রশ্নটিতে সাংবাদিকের একধরনের অসহায়তাও রয়েছে। শ্যাম না কূল কোনটা তিনি রাখবেন তা এক বেজায় প্রশ্ন তাঁর কাছে। সেই বিপদে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে যান। সাংবাদিকতার আদর্শে দীক্ষিত মানুষটি দিনের পর দিন যা লিখতে চান, তা লিখতে পারেন না। কারণ হাউস পলিসি তা এনডোর্স করে না। যদি তিনি তাঁর লেখা প্রকাশই না করতে পারেন তবে তো তাঁর সাংবাদিক সত্তাই তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
তাই সাংবাদিকদের একাংশ সহজ পন্থা ধরেছেন। সবসময় সত্য নয় জেনেও শুধুমাত্র তিনি যে সংস্থায় কাজ করছেন তার নীতি অনুসরণ করছেন। সেক্ষেত্রে জনমানসে কিছু বিশ্বাসযোগ্যতা তিনি হারাচ্ছেন। বিপদ বাড়ছে যখন গণমাধ্যমের মালিকপক্ষ বিশেষ স্বার্থরক্ষায় কোনও বিশেষ ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সেই সময় তিনি সত্যটি জেনেও কারও বিরুদ্ধে যাচ্ছেন না। চাকরি হারাবার ভয়ে ঘরে মেরুদণ্ড বেঁকিয়ে ফেলছেন। আর বাইরেও সেইসব দলের নেতাদের কাছেও সম্ভ্রমটুকু আদায় করতে পারছেন না। হক কথা বলার ধক না থাকলে কেউই পোঁছে না। সাংবাদিকদের একাংশ নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে অথবা অনৈতিকভাবে তাঁদের ছুড়ে দেওয়া কিছু সুযোগ সুবিধা নিয়েই তৃপ্ত। হ্যাঁ, তাতে ব্যক্তিগত কিছু লাভ হয় বটে, কিন্তু যদি তাঁরা ভেবে থাকেন এতে শ্রদ্ধা আদায় হয়, তবে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।
এ তো সাংবাদিক স্তরের কথা। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতার কথা এলেও দেখা যাবে, বিভিন্ন দেশেই রাজনৈতিক এবং কর্পোরেট কুশীলবরা সাংবাদিকতাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করছে, যা আগে এমনভাবে দেখা যায়নি। কোথাও তারা হাত ধরাধরি করে কোথাও একে অন্যের বশ্যতা স্বীকার করে পারস্পরিক স্বার্থসিদ্ধি করছে লক্ষ্য অবশ্য একটাই। সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করা। রাশিয়ায় পুতিনের রাজনৈতিক প্রতাপের কাছে স্বাধীন গণমাধ্যমের মালিক খোদোরকভস্কিকে মাথা নোয়াতে হয়। দশ বছর জেলে কাটাতে হয় পুতিনের চাপে। এখন তিনি মুক্তি। এখন রুশ প্রেসিডেন্ট নিজেও অর্থশালী গোষ্ঠীদের নিয়ে বিব্রত নন। কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর সমালোচনা চলবে না। প্রবল প্রতাপের সেই প্রভাবে রুশ গণমাধ্যম কার্যত নখদন্তহীন। চিনের কথা তো সকলেই জানেন। এমন বহুদেশের কথা জানেন সকলে। আবার এর উল্টোদিকে নরওয়ে সুইৎজারল্যান্ডের কথাও জানেন। তবে সেখানকার পরিপ্রেক্ষিত অনেকটাই আলাদা। যার সঙ্গে অন্তত একশো তেত্রিশ কোটির দেশের সমস্যা এবং স্বপ্নের কোনও মিল নেই।
ভারতেও গণমাধ্যম মালিকানার ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা যাচ্ছে। ভারতে ৮০০ বেশি চ্যানেল আছে। অধিকাংশই কোনও না কোনও রাজনৈতিক নেতা নয়তো কোনও কর্পোরেট সংস্থার অধীন। দক্ষিণের চ্যানেলগুলিতে এই প্রবণতা বেশি। দেশের অন্যান্য প্রান্তেও কম নয়। সুতরাং ‘সংবাদ ব্যবসা’টাও এদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে করা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহ থাকেই।
তার উপর এখনকার উগ্র জাতীয়তাবাদের ঠেলায় গণমাধ্যমজুড়েই একধরনের স্বনিয়ন্ত্রণ দেখা দিয়েছে, যেটাকে মোটেই ইতিবাচক বলা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় অস্বচ্ছ ছবির এই ধোঁয়াশা কাটিয়ে উঠতেই হবে নইলে নিজভূমেই জনগণ পরবাসী হবেন।
Leave a Reply