সান্ধ্য কলহবাসর, নাটুয়া নটবর এবং কিছু কথা
প্রসেনজিৎ সিংহ
অনেককেই বলতে শুনি, আজকাল টিভিতে কী যে সব ছাইপাঁশ দেখায়! সন্ধে হলেই কতগুলো লোক মুখে রংচং মেখে বসে পড়ে। ওরা বিশ্বের সব জানে। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স জানে, ডেঙ্গি জানে, ডিপ্রেশন জানে, আবার ডিমনিটাইজেশন জানে। ঘেন্না ধরে গেল।
যদিও যাঁরা বলেন, মূলত তারাই দর্শক ওই সান্ধ্য-কলহবাসরের। যদি প্রশ্ন করেন, আপনি কী করে জানলেন? উত্তর আসবে, আমি জানব না? রোজ তো দেখছি।
কথাটা ভুল নয়। পরিচিত কিছু মুখ, পরিচিত কিছু ধরনধারণ, পরিচিত কিছু অশীলিত প্রকরণ নিয়ে ওঁরা হাজির হন। নিয়ম রক্ষার্থে বলে রাখা ভাল, সকলের কথা বলছি না। একাংশের। অনুষ্ঠান শুরু আগে কিছুক্ষণ চায়ের টেবিলে বাদী-বিবাদী গলায়-গলায় কুশল বিনিময়। এই পাঞ্জাবিটা কোত্থেকে কিনেছেন, মেয়ের কোন ক্লাস হল, শুনলুম অমুক জায়গায় নাকি তমুক দাদা (নেতা) বিশাল প্রজেক্ট করছেন। দেখুন না একটু, আচ্ছা এখানে নয়, পরে ফোনে কথা হবে….. ইত্যাদি। তারপর অন-স্ক্রিন পরস্পরকে কিঞ্চিৎ গালমন্দ। বিরতিতে আবার আলুপটল, ক্রিকেট, ফিল্মস্টার কপচিয়ে ফের গালমন্দ। অনুষ্ঠান শেষ। শুভেচ্ছা বিনিময়ের হেঁ হেঁ সেরে বিদায় । রাজনৈতিক শিষ্টাচারের হদ্দমুদ্দ।
কারও কারও একদিনে সেকেন্ড ট্রিপ থাকে। এই ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে। ঝোলা ব্যাগে গিন্নি দ্বিতীয় শার্টটি যত্ন করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এঁদের সুবাদে তাঁদের বাড়ির লোকও জানেন, মিডিয়ায় কী পরতে নেই, আর কী পরলে ভাল লাগে। ভাইফোঁটার আগে প্যানেলিস্ট দাদার বউ ঘরোয়া আড্ডায় ননদকে বলেন, ‘‘তোমার দাদাকে এবার যেন স্ট্রাইপ শার্ট দিও না। স্ক্রিনে বড্ড ঝিলমিল করে। ক্যানারি ইয়লো বা ব্রিক রেড দেখতে পারো।’’
এই ‘নাটুয়া নটবর’দের অনেকেই মিডিয়া হাউসে ডেলি প্যাসেঞ্জারির সুবাদে প্রথম থেকেই ‘টেম্পো’ তুলে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছেন। কথার জ্যাক ঘুরিয়ে টিআর পি তুলতে পারেন বলে ওইসব মিডিয়া হাউসে এদের নিজস্ব টিআরপি’ও বেশ হাই।
তবে সকলের সে যোগ্যতা থাকে না। তাদের একাংশ অন্য ফুলে তুষ্ট রাখে মিডিয়া হাউসকে। কোনও কোনও মিডিয়া হাউসে সকাল সকাল কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে টেলি-কনফারেন্সে সেদিনের বিষয় ঠিক হয়। ‘তেমন জোগাড়ে এবং এখনও হালে ততটা পানি পাননি’ নটবর হলে প্রথম দিকে একটু খাটাখাটনি করতে হয়। তাঁরা সকাল সকাল খবরের কাগজে, এবং টেলিভিশনে চোখ বুলিয়ে নিজেদের মতো করে একটা বিষয় প্রস্তাবাকারে পেশ করেন। অবশ্যই সেখানে তাঁর নিজের ভূমিকা থাকবে জেনেই। লেগে গেলে তৎক্ষণাৎ হোয়্যাটসঅ্যাপে বৃহত্তর ‘গুমু’দের মানে গুণমুগ্ধদের এত্তেলা করে দেবেন। আজ রাত ৮টায় আছে, দেখো।
এঁদের একটা বড় অংশ মিডিয়ার সৃষ্টি। তবে মিডিয়াসর্বস্ব এঁদের বলা যাবে না। কারণ মিডিয়া এঁদের ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা করতে অপারগ। কোনও কোনও অবস্থাপন্ন মিডিয়াহাউস এঁদের কিঞ্চিৎ সম্মানদক্ষিণা দেন বটে, তবে তা দক্ষিণার মতোই সামান্য। তবে সম্মানটা নেহাত খাটো নয়। বৃহত্তর দর্শক সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠা। আসল কথা হল, সম্মান তথা সামাজিক প্রতিপত্তি বিস্তার। সে পথটুকু মিডিয়ায় ঘনঘন মুখ দেখানোর সুবাদে কিছুটা সুগম হয়, তাতে সন্দেহ নেই। ডাক্তার-উকিল-অধ্যাপক-খেলোয়াড়-পরিচালক কে নেই, এই তালিকায়। তবে মুখ দেখিয়ে সবচেয়ে লাভবান হন নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক নেতারা।
এমন অনেক নেতা রয়েছেন যাঁদের অস্তিত্বই চ্যানেলনির্ভর। মাঠেময়দানে নেমে ভোটসংগ্রহের প্রতিযোগিতায় (সে পথও কর্দমাক্ত। যত কম বলা যায় ততই ভাল) ফেলুবাবুরা ছোটপর্দায় শার্দুল বিশেষ। কিন্তু এ মায়া প্রপঞ্চময়। আউট অফ সাইট ইজ আউট অফ মাইন্ড। দর্শকের মানসমুকুরে শ্রীবদন কয়েকদিন ধরা না পড়লেই বাঘ চুপসে বেড়াল, চাই কী, ইঁদুর। অতএব চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় নিয়ত। ফিকিরসন্ধানী ফকির চ্যানেলে চ্যানেলে চামর দুলিয়ে যাচ্ঞা করতে থাকেন। এক হপ্তার বেশি কোথাও মুখ দেখাতে না পারলে ভেতরে ভেতরে ঘেমে ওঠেন এঁরা।
তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না, মিডিয়া ব্যবহারকারী এবং ব্যবহৃতরা এক বৃহৎ কুনাট্যের নগণ্য কুশীলব। আরও নির্দিষ্ট করে এঁদের ক্রীড়নক বললেও অত্যুক্তি হয় না। সূক্ষ্ম সুতোয় এরা নিরন্তর নাচছেন। ঠিক যেমনটি চাইছেন চ্যানেল গোষ্ঠী। এঁদের নাচনকোঁদন, বাগাড়ম্বর ততক্ষণই দর্শক-শ্রোতার কাছে পৌঁছয়, যতক্ষণ তোমার সুর আমার সুর মিলছে। অতএব নাটবরকে বুঝে নিতে হয়, পর্দায় তাঁর ব্রহ্মনাদটি যেন আদতে চ্যানেলের অনুনাদ হয়। সেই সুরজ্ঞান, বলতে নেই অনেকেরই রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রকে ভাবিয়ে তুলেছে, চতুর্থ স্তম্ভটির নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার প্রবণতা। অর্থ এবং ক্ষমতার পাঁকে বহুস্বরের ডুবে যাওয়া। নোওম চমস্কি আর এডওয়ার্ড হারম্যান ১৯৮০’র দশকের শেষের দিকে ‘ম্যনুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’-এ সে কথা বলেছিলেন। তাঁদের প্রোপাগান্ডা মডেলের সাহায্যে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, গণমাধ্যমের ঘনীভবন। সেটা কীরকম? বহু সংখ্যক মিডিয়া গোষ্ঠীর পরিবর্তে যখন মুষ্টিমেয় কয়েকটি গোষ্ঠীই দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তখন দর্শকেদর মধ্যে একটা ভ্রম তৈরি হয়, আমি এই চ্যানেল নয়, ওই চ্যানেল দেখি। অর্থাৎ নিজেই স্থির করি আমার খাদ্য। কিন্তু এই চ্যানেল আর ওই চ্যানেলে খুব ফারাক থাকে না, তখন যা-ই তুমি দেখো না কেন খাবারটা মোদ্দা একই। দেশের দিকেও তাকিয়ে দেখুন। সাকুল্যে গোটা ছয়েক গোষ্ঠী ছড়ি ঘোরাচ্ছে মিডিয়া ওয়ার্ল্ডে।
আবার বিজ্ঞাপনের তথা বাণিজ্যগোষ্ঠীর প্রভাব দেখুন। তারা সিরিয়ালে পয়সা ঢালে বেশি। নিউজে কম। ফলে আবার সেই অর্থের প্রভাব। খবরের বিষয়বস্তুতে সিরিয়াসনেস কমছে। বিনোদন বাড়ছে। খবরের বিনোদনমূল্যের কথা ভাবা হচ্ছে আজকাল।
মিডিয়ায় ফেসভ্যালু বলে একটা কথা চালু আছে। অমুকবাবু কথাটা বললে মানুষ সহজে বিশ্বাস করেন। অতএব অমুককে দিয়ে বলাও। মিডিয়া ভাজামাছটি উল্টে খেতে জানে না। তারা বলবে, আমরা নিজেরা তো কিছু বলিনি। উনি যা বলেছেন, সেটা প্রচার করেছি মাত্র। প্রচারের এই সূক্ষ্মধারার প্রচলন বাংলায় বহুদিন হয়েছে। কেউ নজর করেছেন, কেউ করেননি।
অর্থাৎ আপনার জানার বোঝার পরিসরটুকুকেও নিয়ন্ত্রণ করা হবে সুকৌশলে। জনমত গড়ে তোলার এই কৌশলেরই শিকার নটবরেরা। মিডিয়াও।
অতএব গণতন্ত্রের যাত্রা শুনতে যাওয়া খুব সহজ নয় আজকের দিনে!
Leave a Reply