সাহসিকতাই বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে
প্রসেনজিৎ সিংহ
বছরটা মিডিয়ার জন্য তেমন সুবিধের নয়, বোঝা গেল। বছরের প্রথম থেকেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে নানারকম নিন্দামন্দ ধেয়ে আসছে একের পর এক। এ বছর জানুয়ারিতে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে’র রিপোর্ট থেকে শুরু করে বছরের শেষপ্রান্তে ‘দ্য ইকনমিস্ট’-এর চওড়া থাপ্পড়। মাঝখানেও মিডিয়ার নানা খামতি নিয়ে দেশের মধ্যেও চর্চা হয়েছে বিস্তর। কখনও কাটজু, কখনও মনমোহন সিংহ। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণববাবুও বাদ যাননি।
নিন্দামন্দের মূল লক্ষ্য মিডিয়ার মূলধন, মানে বিশ্বাসযোগ্যতা। যেটা তৈরি হয় সাংবাদিকদের সত্যনিষ্ঠা আর পরিশ্রমের বিনিময়ে। কিন্তু কোন সত্য? মালিকের সত্য? পাঠকের সত্য? না কি শাসকের সত্য? না কি যে সাংবাদিক দেখছেন শুনছেন, অনুসন্ধান করছেন তাঁর সত্য? ছোটবেলায় শুনেছিলাম সত্য একটাই। এখন জেনেছি সত্যেরও বহু রূপ। এ যুগে সবক’টি সত্য আর একবিন্দুতে মেলে না। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের সত্য সাংবাদিকের অনুসন্ধানলব্ধ সত্যই হওয়া উচিত। বাকি সব সত্যের এখন জয়জয়কার। শুধু সাংবাদিকের সত্যটি ছাড়া।
আচ্ছা, সেই সত্যটিকে মানুষ তথা পাঠক-শ্রোতা-দর্শক কি আজ আর প্রত্যাশা করেন সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে? সম্ভবত না। শাসকদলের সঙ্গে মিডিয়ার গাঁটছড়া। বড়বড় শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে মিডিয়া মালিকের গাঁটছড়া। বড়বড় শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে শাসকের গাঁটছড়া। এত গাঁট পেরিয়ে সাংবাদিকের কণ্ঠস্বর উঠে আসা কি চাট্টিখানি কথা! তাঁকে চাকরি করতে হয়। যা দেখেন যা বোঝেন সবটা বলতে পারবেন কী করে! তাঁকে সমাজেও প্রভাবশালী হিসাবে পরিচয় পেতে হয়। পেশাগত কারণেই নেতামন্ত্রীর সঙ্গে ওঠাবসা করতে হয়। ওই ওঠাবসাই কখন নেতামন্ত্রীদের অঙ্গুলিহেলনে ওঠবোস হয়ে যায়, অনেকেই আজকাল তা বুঝতে পারছেন না। কিংবা পেরেও অসহায়ের মতো চাকরি বাঁচাতে, নির্লজ্জের মতো চোখকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। দুই-ই আছে। কেউ স্বেচ্ছায় করছেন কেউ বাধ্য হয়ে। কোনওটাই সমর্থনযোগ্য নয়।
এই অসমর্থনযোগ্য সাংবাদিকতায় পাঠক অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। ভুলে গেলে তো চলে না পাঠকেরও সাংবাদিকের মতোই চোখকান খোলা রয়েছে। আজ আর সেই দিন নেই, শুধু ছাপার অক্ষরে দেখলেই তাকে মানুষ সত্য বলে ধরে নেবে। ইন্টারনেট আছে, সোশ্যালমিডিয়া রয়েছে। উন্নত যোগাযোগ রয়েছে। তথ্য নানা উপায়ে নিয়ত হাতের মুঠোয় বন্দি হচ্ছে মানুষের। তাঁদের সত্যও তাঁরা যাচাই করে নিচ্ছেন জটিল প্রক্রিয়ায়। ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই।
ভারতে ছোটবড় মিলিয়ে ৮০০-র বেশি নিউজ চ্যানেল রয়েছে। সংবাদপত্র রয়েছে ৮২ হাজার (আর এনআইয়ের হিসাব) কমিউনিটি রেডিও-সহ সরকারি বেসরকারি রেডিও স্টেশন দেড়হাজার। সবমিলিয়ে সংখ্যাটা বেশ বড়। ভারতের এইসব গণমাধ্যমে কয়েকলক্ষ সাংবাদিক কাজ করেন বলে ধরে নেওয়া যাতে পারে। এদের মধ্যে যাদের কথা-শব্দ-ছবি জনমত তৈরি করতে পারে, নতুন করে মানুষকে ভাবাতে পারে, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাওয়াটা কি শুধুই পরিস্থিতি আর পারিপার্শ্বিকতার দোহাই দিয়ে এড়ানো যায়! কমবেশি চোদ্দকোটি মানুষের ব্রডব্যান্ড কানেকশন রয়েছে। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তবে সংখ্যার গরিষ্ঠতা গণতন্ত্রে ফলদায়ী হলেও ভারতের মতো বিপন্ন গণতন্ত্রের এখন সংখ্যার চেয়ে বেশি দরকার গুণমানের। তেমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আর কে দেখাচ্ছেন!
‘দ্য ইকনমিস্ট’ বলেছে পাকিস্তানের সাংবাদমাধ্যম ভারতের চেয়ে সাহসী। গণতান্ত্রিক পরিবেশের কথা বললে, পাকিস্তানকে আমাদের অনেকটা পিছনে রাখতে হবে। কিন্তু সেই পরিবেশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সাহসিকতা যদি এদেশের চেয়ে বেশি হয়, তবে অস্বস্তিকর আমাদের সংবাদমাধ্যমের কাছে।
সাহসিকতাই সেই বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে যা সংবাদমাধ্যমের অমূল্য সম্পদ। সেই সম্পদ আগলে রাখার মতো উষ্ণীষ। ক্ষমতার পায়ের কাছে রাখার নয়।
Leave a Reply