সম্পাদকের ক্ষমা ভিক্ষা আর বাংলাদেশের মিডিয়া ক্যু
Graphic: Prabal Dhar
সত্যিটা স্বীকার করে ঔদার্য দেখাতে গিয়ে ভালই ফেঁসেছেন বাংলাদেশের সব চেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ডেলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনম।
বাংলাদেশের ছোট-বড় সব আদালত মিলে নয় নয় করে প্রায় হাজার দেড়েক মামলা, পাহাড়ে ধসের পরে নেমে আসা পাথর আর বোল্ডারের চাঁইয়ের মতো তাঁকে আপাদমস্তক ঢেকে তো ফেলেছেই— বলা ভাল মাটিতে পুঁতেও ফেলেছে। এই সব মামলা সামলাতে সামলাতে বৃদ্ধ আনম সাহেব আর তাঁর মিডিয়া হাউসের এখন হিমশিম অবস্থা।
কী স্বীকার করেছিলেন ডেলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনম?
স্বীকার করেছিলেন— ও দেশের সামরিক গোয়েন্দাদের দেওয়া বেশ কিছু ‘ভিত্তিহীন সংবাদ যাচাই না-করে প্রকাশ করেছিলেন’ তাঁরা, যা একেবারেই উচিত হয়নি। সেই সব সংবাদের ওপর সম্পাদকীয় প্রতিবেদনও লেখা হয়েছিল। খুবই গর্হিত কাজ হয়েছিল এটা। এ জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।
বাংলাদেশের বেসরকারি সংবাদ-চ্যানেলগুলোয় সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত পর্যন্ত ‘টক শো’-এর নাটক চেটেপুটে খান দর্শক। এমনই এক ‘টক শো’-এ সংবাদমাধ্যমে নৈতিকতা বিষয়ে বলছিলেন ঢাকার সাংবাদিক মহলে শ্রদ্ধেয় আনম সাহেব। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে ডেলি স্টার-এ প্রকাশিত কিছু সংবাদ নিয়ে সেই অনুষ্ঠানেই প্রশ্ন ওঠায় প্যাঁচে পড়ে যেতে হয় তাঁকে। কাগজের সম্পাদক হওয়ায় দায় তাঁরই।
তখনই মাহফুজ আনমের এই স্বীকারোক্তি ও ক্ষমা চেয়ে দায়মুক্তির চেষ্টা।
কিন্তু সে সব ‘ভিত্তিহীন’ সংবাদ যদি সেই দিন কারাবন্দি, এখন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আর্থিক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির বিষয়ে হয়, ক্ষমা চেয়েই কি দায়মুক্ত হতে পারেন সম্পাদক মশাই?
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার জন্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৬-এর শেষে বাংলাদেশে যে অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে প্রশাসনের ভার তুলে দিয়েছিলেন, সেনাপ্রধানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ২০০৭-এর ১১ অক্টোবর মধ্যরাতে তারাই ক্ষমতা দখল করে বসল। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জেলে ভরা হল বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকেও। ১৯৭১-এ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে বারে বারে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছে সেনারা। অসামরিক (বেসামরিক শব্দটি বেশি চলে বাংলাদেশে) সরকারের প্রায় সমান সময় বাংলাদেশ কাটিয়েছে সেনাশাসকদের হাতে। বারে বারে খারিজ হয়েছে, সংশোধন হয়েছে সংবিধান। দেশ ছেড়ে পালানো স্বাধীনতার বিরোধিতা করা পাকিস্তান-পন্থী নেতাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে রাজনৈতিক পুনর্বাসন দিয়েছেন সব চেয়ে বেশি মেয়াদের দুই সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মহম্মদ এরশাদ।
সে হিসেবে ২০০৭-এর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুব একটা চমক নয়। কিন্তু চমক হল, এ বার আর নিজেরা ক্ষমতা ধরে থাকার জন্য নয়, ক্ষমতায় এসেই সেনারা বুঝিয়ে দিল— তাদের লক্ষ্য দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে নতুন একটি ক্ষমতার অক্ষ প্রতিষ্ঠা। বলা শুরু হল, ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা প্রয়োগের জন্যই সেনারা ক্ষমতা দখল করেছে। অন্যান্য বারের মতো সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়ার বদলে তাদের দেওয়া সংবাদ ছাপানোর ‘বন্দোবস্ত’ করল বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ ডিজিএফআই (ডিরেক্টর জেনারেল অব ফোর্সেস ইনটেলিজেন্স)। প্রতিদিনই প্রায় দুই নেত্রীর সম্পর্কে নানা খবর প্রকাশিত হতে থাকে ‘বিশেষ সূত্র’ উদ্ধৃত করে। আগের পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া, অথচ কেলেঙ্কারির খবর বেশি বেরোতে লাগল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। বিশেষ সূত্র জানায়— জেরায় সে সবই নাকি স্বীকার করে নিয়েছেন হাসিনা। অথচ তা যাচাইয়ের কোনও সুযোগ নেই। কারণ হাসিনা তো বটেই, তাঁর দলের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাও জেলে। তাঁদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ গাড়িতে মদের খালি বোতল রাখা, তো কারও পুকুরে সরকারি টিন খুঁজে পেয়েছিল সেনা-পুলিশ।
অনেক সংবাদপত্র ডিজিএফআই-এর খাওয়ানো সেই সব খবর গুরুত্ব দিয়ে না-ছাপলেও মাহফুজ আনম সাহেবের কাগজ তা প্রকাশ করে ফলাও করে। তার ওপর সংবাদ ভাষ্যও প্রকাশ করা হয়, যা থেকে পাঠকরা মনে করতে থাকেন— কাগজটি সেনা-শাসনের সমর্থক। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ‘মাইনাস টু’ সফল হওয়ার আগেই ২০০৮-এর শেষে নির্বাচনের ঘোষণা করে ক্ষমতা ছাড়তে হল সেনা-সরকারকে। বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী হলেন সেই শেখ হাসিনা। পদ্মা-মেঘনায় অনেক জল গড়িয়ে গেলেও রয়ে গিয়েছে ডেলি স্টার-এ প্রকাশিত সেই সব ‘খবর’। তার পরে নৈতিকতা নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া সেই কাগজের সম্পাদকের শোভা পায় না। সম্পাদক এখন ভুল স্বীকার করার অর্থ, ইচ্ছাকৃত ভুল সংবাদ প্রকাশ করে তত্কালীন বিরোধী নেত্রীর মানহানি করেছিল কাগজটি। এই অভিযোগ তুলেই একের পর এক মামলা। বাদীরা সকলেই সরকারি দলের কর্মী-সমর্থক।
কিন্তু মিডিয়াকে সেনা শাসকদের ব্যবহারের আর এক কীর্তিও শুনে এসেছি বাংলাদেশ থেকে।
সেটা ২০০১। অক্টোবরের প্রথম দিনটিতেই সাধারণ নির্বাচন। সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ গিয়ে সর্বত্রই শুনি, শেখ হাসিনাকে আর ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না। পরিকল্পনা পাকা। ক্ষমতায় আনা হবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি–জামাতে ইসলামির জোটকে।
কে করল এই পরিকল্পনা? প্রশ্ন শুনে সকলেরই নজরে তাচ্ছিল্যের ভাষা— এটুকুও জানে না? খবর করতে এসেছে ইন্ডিয়া থেকে!
কিন্তু পরিষ্কার করে কেউই বলেন না। বলি, ভোট তো দেবেন সাধারণ মানুষ। আগে থেকে ফল ঠিক করে রাখা কী করে সম্ভব? জবাব পাই— ‘ভোট আবার কী! ভোট তো জিয়ার আমলে, এরশাদের আমলেও হয়েছে। মানুষ কী তাগো ভোট দিয়াসিল? ফল বেরোলে প্রতিবার তাদের লোকেরাই জিতেছে। এ বারেও তেনারা দরকারে ‘মিডিয়া ক্যু’ করে নেবেন। কিন্তু জামাতকে ক্ষমতায় আনা এক্কেবারে ফাইনাল।’
এই ‘মিডিয়া ক্যু’-টা কী বস্তু?
আবার সেই বাঁকা নজর, যার নিহিত অর্থ— কোত্থেকে আসে সব!
কিন্তু সত্যি জানি না। সে বার বাংলাদেশ যাওয়ার আগে কানেই শুনিনি কখনও। সুতরাং শরণাপন্ন হলাম পূর্ব পরিচিত এক বামপন্থী নেতার। দাদা এই ‘মিডিয়া ক্যু’-টা ঠিক কী! বাঁকা হেসে তিনি আর উড়িয়ে দিলেন না। বরং তাঁর হাতে কলমে অভিজ্ঞতার কাহিনিই শোনালেন।
সেনাশাসকরা বারে বারে দেশে নির্বাচন করিয়ে নিজেদের গণতান্ত্রিক প্রমাণের চেষ্টা করে গিয়েছেন। কখনও দলীয় প্রতীকে, কখনও নির্দলীয় ভাবে। কিন্তু সেনাদের পছন্দের বাইরের কোনও লোক কখনও জয়ী হয়নি সে নির্বাচনে। তবু সংগঠনে তেল দিতে, সেনাশাসনের কোটি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে রাজনৈতিক দলগুলি সে নির্বাচনে অংশ নিত। কিন্তু ‘মিডিয়া ক্যু’-র বিষয়টি আসে এরশাদ আমলে। বরিশানের বাবুগঞ্জ আসনে সে বার প্রার্থী ছিলেন বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন। তখন মোবাইল ফোনের যুগ আসেনি। গণনাকেন্দ্রের সঙ্গে বাইরের কোনও যোগাযোগই নেই। মেননের কাউন্টিং এজেন্টরা দেখছেন, তাঁদের নেতা যত ভোটে এগিয়ে যাচ্ছেন, বাইরে প্রতিপক্ষের সমর্থকদের উল্লাস বাড়ছে। কারণটা কী, বুঝতে পারছেন না তাঁরা। একটা সময়ে কিছু সেনা অফিসার এসে গণনা বন্ধ করে দিয়ে সকলকে চলে যেতে বলল। প্রতিবাদ করে কোনও লাভ নেই। কারণ, বাইরে তখন ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, সমস্ত ব্যালট গোনা শেষ। রাশেদ খান মেনন প্রায় ৩০ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছেন। রেডিও-টেলিভিশনে সে ‘খবর’ ঘোষণাও করে দেওয়া হয়েছে। কাউন্টিং এজেন্টরা বাইরে এসে জানতে পারেন, প্রতি রাউন্ডের পর সেনাশাসকদের পছন্দের প্রার্থীর এগিয়ে থাকার খবরই প্রচার করা হয়েছে। সব ক’টি সংবাদ মাধ্যমেও তা প্রচারিত হয়েছে। সুতরাং বলা যাবে না যে মেনন জিতছিলেন, আর সেনারা এসে তা ভন্ডুল করে দিয়েছে।
শুধু মেনন নন, সেনাশাসকরা সে বার অনেককেই হারিয়েছে এ ভাবে মিডিয়ায় পরিকল্পনা মাফিক মিথ্যা প্রচার করে— যাকে বাংলাদেশের মানুষ বলেন ‘মিডিয়া ক্যু’।
২০০১-এ আমার দেখা সেই ভোটে কিন্তু বিএনপি-জামাতই ক্ষমতায় আসে। কিন্তু তার জন্য মিডিয়া ক্যু-কে দায়ী করা যায় না। ভোটের দিন ঢাকার বুথে বুথে ঘুরে বা টেলিভিশনে লাইভ ব্যালট গণনা দেখে আমার অন্তত তেমন কিছু চোখে পড়েনি। বরং বাংলাদেশের সর্বত্র শাসক আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে বিপুল বিরাগ-বিরক্তি দেখেছিলাম মানুষের মধ্যে— যা থেকে নিশ্চিত ছিলাম শেখ হাসিনাকে আর ক্ষমতায় ফিরতে হচ্ছে না। খালেদা জিয়া সে বার জিতেছিলেন শাসক দলের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভোটেই। কিন্তু ফল প্রকাশের পরই শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন— ‘‘এই ভোট কারচুপির ভোট। সাজানো ভোটের ফল আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল।’’ শাসক দলের একটা বড় অংশ যে সে কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন, সেটাও দেখেছি।
চার-পাঁচ দিন পরে ফিরতি বিমান ধরতে ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েছি। অফিসার আমার পাসপোর্টের ভিসার পাতা খুলে দেখেন লেখা— বিদেশি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক। ম্লান মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন নির্বাচন দেখলেন?
বললাম, ভালই তো। বিশেষ গণ্ডগোল হয়নি।
অফিসার উদাস ভাবে পাসপোর্ট ফেরত দিতে দিতে বললেন, ‘‘নির্বাচন আর হলো কই যে দ্যাখবেন! মানুষ ভোট দিসে এক, ফল বেরোল আর এক। মিডিয়া ক্যু হয়ে গিসে। আপনেরা ট্যারটিও পান নাই। খোদা হাফেজ!’’
Comments (3)
-
-
সেনাশাসন নির্বাচন বিষয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসটা যে ভাবে ভেঙে দিয়েছে, তা কবে ফিরবে বলা কঠিন। কোনও নির্বাচনের ফলই মেনে নেন না পরাজিত পক্ষ। চলে সংসদ বয়কট। বিরোধীরা নামেন হরতাল আর নাশকতার পথে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পক্ষে এটা আরও ভয়ের। কারণ এ দেশের একটা প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তির কর্মসূচি ‘পশ্চিমি গণতন্ত্র’ উচ্ছেদ করে শরিয়তি শাসন ব্যবস্থা কায়েম। তারা বিপুল প্রতিপত্তিশালী। তাদের আক্রমণের মুখে এই খোঁড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কতটা লড়াই দিতে পারে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ধন্যবাদ সীমন্তিনী।
-
-
‘বিশেষ সূত্র’ উদ্ধৃত করে, একটি সূত্রের খবর, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন— এই নিয়েই দিন কাটছে দাদা। তবে পরের বারের বাংলাদেশ ‘কভারেজে’র সময় ভিসা সামাল দিয়েন ভাইজান। ‘মিডিয়া ক্যু’ না হইয়া jaয়।
‘ভোট দিসে এক, ফল বেরোল এক’। এই হক কথাটা দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্রেরই ভোট ছবি!