রীতি, নীতি, ভীতি
১.
নিরপেক্ষতা বলে কিছু আছে বলে আমি অন্তত স্বীকার করি না। বিশ্বাস করি আমরা আসলে প্রকট বা প্রচ্ছন্ন ভাবে পক্ষ নিয়েই থাকি। সংবাদমাধ্যম তার ব্যতিক্রম নয় বলেই অনুমান করি। আমাদের অভিজ্ঞতা সেই অনুমানকে সত্য বলেই প্রতিষ্ঠা করে। তাই কোনও নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যম কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে খবর ছাপলে অবাক হওয়ার কিছু নেই বলেই বিশ্বাস করি। তবু ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি, ওই পক্ষ নেওয়ার মধ্যেও এক ধরনের বস্তুনিষ্ঠতা থাকা উচিত। সেখানেই সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতার বিষয়টিও প্রোথিত থাকে। কিন্তু অবাক হতে হয়, হতাশ হতে হয় তখনই যখন দেখা যায় সংবাদমাধ্যমের খবরে বহু ক্ষেত্রে সেই নৈতিকতাও অনুপস্থিত।
বহু চর্চিত পার্কস্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের রায় সদ্যই বেরিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই গণপরিসর এবং সংবাদমাধ্যমে চর্চা কম হয়নি। ঘটনাটি ঘটার অনতিবিলম্বে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাটিকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাই নিয়ে চাপানউতোর কম হয়নি। এবং তার পর থেকে সাজানো ঘটনা রীতিমতো প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছে এই বঙ্গে।
শুরুতেই লিখেছি নিরপেক্ষতা বলে কিছু হয় না এবং সংবাদমাধ্যমও বহু ক্ষেত্রে স্পষ্ট ভাবে পক্ষ নিয়েই থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারি দলের সমর্থনে থাকা সংবাদমাধ্যম মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে সমর্থন করে খবর নির্মাণ করবে এমনটাই স্বাভাবিক। তেমনটাই হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কলকাতা পুলিশের তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের উল্টো পথে হেঁটে ‘কিছু একটা ঘটার’ কথা জানিয়েছিলেন। এ সব পুরনো কথা।
তিন বছর ধরে আদালতে বিচারপ্রক্রিয়া চলার পরে অবশেষে কিছু দিন আগে রায় বেরিয়েছে এবং সেখানে অভিযুক্তেরা ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। তাদের শাস্তিও ঘোষিত হয় আদালতে। এই রায় ঘোষণা অবশ্য শুনে যেতে পারেননি সে দিনের ধর্ষিতা। সুজেট জর্ডনের মৃত্যু হয়েছিলো গত মার্চেই। বিচার চলাকালীন সময়ের মধ্যেই। আমার আলোচ্য বিষয়টি সেই মৃত্যু নিয়ে করা খবরে। আশ্চর্যের বিষয়, সরকারি দলের অনুগত এক সংবাদপত্রে সেই মৃত্যুর খবরের শিরোনাম হয় ‘পার্ক স্ট্রিটের ভুয়ো ধর্ষণকাণ্ডের সুজেট প্রয়াত’। হ্যাঁ, আশ্চর্যটা সেখানেই। বিষয়টি তখনও বিচারাধীন। কিন্তু সেই যে কবে মুখ্যমন্ত্রী তাকে সাজানো ঘটনা বলেছিলেন, তাই তাঁর দলের অনুগত সংবাদমাধ্যমকে সেই ‘লাইন’ বজায় রেখেই খবর করে যেতে হবে। তাই তাকেই আদালত হয়ে ধর্ষণের ঘটনাটি ভুয়ো— এই মর্মে রায় বানিয়ে খবর করতে হবে। সেখানে সংবাদমাধ্যমের ঘোষিত নীতির নৈতিকতা বজায় থাকলেও প্রকৃত নৈতিকতাকে গলা টিপে খুন করা হয়।
২.
এ তো গেলো আনুগত্য থেকে জন্ম নেওয়া পক্ষ নেওয়ার কথা। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোটা সংবাদমাধ্যমই চলে আসে একটা পক্ষে। এবং তা হয়তো অনৈতিকতারই পক্ষে।
এই ঘটনাটিও খুব বেশি পুরোনো নয়। গোটা সংবাদ মাধ্যম তখন মশগুল ওই ঘটনাটি নিয়ে। যে ঘটনা ‘কঙ্কাল কাণ্ড’ হিসেবে পরিচিত। কলকাতার রবিনসন স্ট্রিটে একটি বাড়িতে দিদি ও দুই পোষ্যের কঙ্কালের সঙ্গে ছ’মাসের বেশি সময় ধরে ছিলেন পার্থ দে নামের এক ব্যক্তি। তাঁর বাবার দগ্ধ দেহ উদ্ধার করতে গিয়ে সেই কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। এবং তার পর থেকে গোটা সংবাদমাধ্যমের বেশির ভাগ জায়গা জুড়েই ছিলো ওই ঘটনা। আমজনতাও প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন খবর পাওয়ার জন্য উৎসুক তখন। ঘুমোতে যাওয়ার আগে শেষ খবর এবং ঘুম থেকে উঠে প্রথম খবর, সবটাই কঙ্কালকেন্দ্রিক। ঠিক তখনই সংবাদমাধ্যমের হাত ধরে প্রকাশ্যে আসে পার্থ দে-র লেখা ডায়েরি। সেই ডায়েরির সূত্র ধরে উঠে আসে পারিবারিক অনৈতিক যৌন সম্পর্কের নানান রকম সন্দেহ আর অনুমান।
আর এখানেই ফের বড় হয়ে ওঠে নৈতিকতার প্রশ্নটি। কেউ খবর হয়ে উঠলে কি তাঁর ডায়েরিও ব্যক্তিগত থাকার যোগ্যতা হারায়? কোনও ঘটনার তদন্তকারীরা সব দেখে তদন্ত করবেন, এটাই রাষ্ট্রস্বীকৃত নিয়ম। ডায়েরির কোনও সূত্র ধরে অপরাধের প্রমাণ হলে তা প্রকাশ্য হয় এবং তা খবর হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু তাই বলে কারও ব্যক্তিগত ডায়েরির নানান লেখা কি আমজনতার জন্য চর্চার বিষয় করে দেওয়া নৈতিকতার সাপেক্ষে উচিত? ‘অস্বাভাবিক লোকের’ কি ব্যক্তিগত বলে কিছু হতে পারে না? আমজনতার বিচারের আদালতে তাঁর সব কিছুই কি পেশ করতে হবে সংবাদমাধ্যমকে? যে সংবাদমাধ্যম মানুষের ব্যক্তি অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সোচ্চার হয়, মানুষের ব্যক্তি অধিকার লঙ্ঘিত হলে যে সংবাদমাধ্যম সরব হয়, সেই সংবাদমাধ্যমই এ ক্ষেত্রে একজন মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়কে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে মহা উৎসাহে। এবং সেখানে সব সংবাদমাধ্যমই এক পক্ষে। নতুন নতুন তথ্য দিয়ে বাজার ধরার পক্ষে। ব্যক্তিগতকে এ ভাবে খবরের হাত ধরে প্রকাশ্যে আসতে দেখলে এক ধরনের ভয় হয়। খবরের নামে সবার সামনে উলঙ্গ হওয়ার ভয়। খবর হয়ে উঠলে কি আমাদের ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকবে না আর? তাই এই কারও ব্যক্তিগত ডায়েরিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার কাজটা ঠিক কতটা নৈতিক, এই প্রশ্নটা তীব্র খোঁচা মেরে যাচ্ছিলো তখন। প্রশ্নটা রইলো বাকিদের কাছেও।
Comments (2)
-
ভাল কথায় কৌতূহল, চলতি কথায় উঁকি দেওয়া, মানুষের মজ্জাগত। সেই স্বভাবটাকেই কাজে লাগায় সংবাদমাধ্যম। পেজ থ্রি নামক যে বস্তুটি সংবাদমাধ্যমে চলে তা তো পুরোটাই উঁকি। আর মিডিয়া মুঘলেরা সেই উঁকিটাকেই পুঁজি করেন। যার ভাল বাংলা হল, মানুষ জানতে চায়। এর পরে আর কী কথা থাকতে পারে।
Aporadher proman diary te mille take todonter kaje lagano jete pare,samasya bujhle byaktir chikitsar kajeo tathya byabahar kora jai.kintu take sokoler samne ulongo Kore tule dhora aporadh!media r nijosso motamot thakte pare,esab nie byabsa korar adhikar nei