একটি প্রত্যাশিত মৃত্যু, একটি অপ্রত্যাশিত খবর
চোখে পড়েছে কখনও? খবরের কাগজের কোনও ভেতরের পাতায়, নীচের দিকে, ছোট্ট করে গুঁজে দেওয়া একটা খবর— ‘দলিত নারীকে ধর্ষণ’, বা ‘দলিত যুবককে মার’। পড়েছেন খবরটা? নাকি পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছেন বড় মাপের কোনও চটকদার খবরের টানে?
সেই চোখ বন্ধ করে, মুখ ফিরিয়ে রাখার বদ অভ্যাসকে অবশ্য কিছু দিনের জন্য নাড়িয়ে দিলেন রোহিত চক্রবর্তী ভেমুলা। হ্যাঁ, ‘দলিত’ রোহিত চক্রবর্তী ভেমুলা। রোহিতকে বুঝতে এই ‘দলিত’ শব্দটা খুব জরুরি। কারণ তাঁর জীবন, এবং তাঁর শোচনীয় মৃত্যু, নির্ধারিত করে দিয়েছিল এই ‘দলিত’ পরিচয়।
২৭ বছরের রোহিত বিজ্ঞানের শাখায় গবেষণা করতেন দেশের অন্যতম নামজাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। লক্ষ্য শুধু পিএইচডি ডিগ্রি নয়, বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে এই দুনিয়াটা কিছুটা হলেও পাল্টে দেওয়া। কয়েক বছর পরে হয়তো তাঁর পিএইচডি জুটে যেত। কিন্তু তার আগেই দিনবদলের স্বপ্ন আঁকড়ে থাকার মাসুল দিতে হল রোহিতকে। লব্ধপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর প্রান্তিক অবস্থান তাঁকে হতাশার পাহাড়ে এমন এক কিনারায় এনে দিয়েছিল, যেখান থেকে খাদে পড়ে যাওয়াটা যেন সমাজ-নির্ধারিতই!
আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া রোহিতের চিঠি দিন কয়েক আগে দেশের প্রায় সব কাগজের প্রথম পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছিল। কী ছিল সেই চিঠিতে? রোহিত লিখেছিলেন, ‘‘এক জন মানুষের মূল্য এখন গিয়ে ঠেকেছে তাঁর পারিবারিক পরিচয়ে, ভোটে, একটা নম্বরে, একটা বস্তুতে। কাউকে তাঁর মন দিয়ে বিচার করা হয় না।’’
রোহিতের এই মৃত্যু কি ব্যতিক্রম? ২০১৫-র ২২ অক্টোবর প্রকাশিত একটি খবর বলছে, ২০১৪ সালে ৭৪৪ জন দলিত-হত্যার খবর জানা গিয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে দুধের শিশু, রয়েছেন আশি ছুঁই-ছুঁই বৃদ্ধাও। এ ছাড়া আছেন বহু জখম দলিত। কারও মুখ অ্যাসিডে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কেউ ধর্ষিতা, কেউ বা বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেয়ে হাত-পা খুইয়ে হাঁটা-চলার ক্ষমতা হারিয়েছেন। আত্মহত্যার সংখ্যাও বহু, তবে তার কোনও পরিসংখ্যান মেলেনি। আর পুলিশের কাছে পৌঁছয়নি, এ রকম কত শত দলিত-নিগ্রহের ঘটনা যে হয়েছে, হয়ে চলেছে, তা-ও জানা যায়নি।
সেই সব ঘটনা অবশ্য ‘খবর’ হয়ে উঠতে পারেনি। যে-ভাবে খবর হয়ে উঠলেন রোহিত। তাই রোহিতের মৃত্যু ‘ব্যতিক্রম’ না-হলেও বলাই যায়, তাঁর খবর হয়ে ওঠাটা ‘ব্যতিক্রম’ বটে।
এ দেশের সংবাদমাধ্যম ‘মনুবাদী’, এই অভিযোগ নতুন নয়। বহুজন সমাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কাঁসি রামের মতে, ‘উচ্চবর্গীয়দের’ মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যমকে কখনওই বিশ্বাস করা উচিত নয়। তার থেকে উচিত, দলিতদের নিজস্ব মুখপত্র প্রকাশ করা। কিন্তু কোনও ‘দলিত’ খবরের কাগজ সে ভাবে কি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে? এই সব পত্র-পত্রিকার পাঠক সংখ্যাই বা কত?
প্রশ্নগুলো গোলমেলে, উত্তরগুলো জানা হলেও আমরা না-জানার ভান করে থাকি। তবে দলিত খবরের এই হারিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক দলিত সমাজকর্মী এ দেশের সংবাদমাধ্যমে ‘উচ্চ বর্গের’ রমরমাকে দায়ী করেছেন। ইন্ডিয়াজ নিউজপেপার রেভোলিউশন: ক্যাপিটালিজ্ম, পলিটিক্স অ্যান্ড দ্য ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ প্রেস, ১৯৭৭-৯৯ (২০০০) বইটিতে কানাডীয় অধ্যাপক ও গবেষক রবিন জেফরি বলেছেন, ‘‘ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের নিউজরুমে দলিত সাংবাদিক প্রায় নেই বললেই চলে। নব্বই দশকের আগেও ছিল না, এই ১৯৯৯-তে দাঁড়িয়েও বলতে পারি, এখনও নেই!’’
তার পরের এই কয়েকটা বছরে নিউজরুমগুলোর চেহারা আমূল পাল্টে গিয়েছে, এ রকম ভাবার কোনও কারণ ঘটেছে কি? ২০১৩ সালে বর্ষীয়ান সাংবাদিক এজাজ আশরফ লিখেছিলেন, সারা দেশে মাত্র ৩১ জন ‘দলিত’ সাংবাদিককে চেনেন তিনি। সংখ্যাটা, হাস্যকর রকমের কম। এ দেশের ২৫ শতাংশ নাগরিক তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত। কিন্তু সেই ‘উপস্থিতি’র বিশেষ প্রতিফলন সংবাদমাধ্যমে কাজ করা বিপুল জনসংখ্যার মধ্যে পাওয়া যায় না। আর তার ফলেই ‘দলিত’ খবরকে তুলে ধরার কাজটাও বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম ঠিক ভাবে করে উঠতে পারে না।
দলিত পাঠকদের নিয়ে করা একটি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ৮৭ শতাংশ দলিত পাঠক মনে করেন, এ দেশের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম ‘উচ্চবর্গীয়’ মদতপুষ্ট। ৮০ শতাংশের ধারণা, বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার মন জুগিয়ে চলাই অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের প্রধান চরিত্র। ৭৮ শতাংশ দলিত পাঠকের মতে, সব ধরনের খবর পৌঁছে দেওয়ার থেকে মুনাফা লোটাতেই বেশি তৎপর বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম (দ্রষ্টব্য: এস কুমার, দলিত অ্যান্ড অল্টারনেটিভ মিডিয়া: আ স্টাডি অন দলিত্স এনগেজমেন্ট ইন আর্টিক্যুলেশন অব দেয়ার ভয়েসেস ইন দ্য ইন্ডিয়ান ব্লগ্স অ্যান্ড ওয়েব পোর্টাল্স, পিএইচডি ডিজারটেশন, পেরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৪)।
এই টুঁটি-চেপে ধরা পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বর সকলের কাছে পৌঁছে দিতে অল্টারনেটিভ বা ব্যতিক্রমী সংবাদমাধ্যমকে বেছে নিচ্ছেন অনেক দলিত সাংবাদিক, গবেষক ও সমাজকর্মী। ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে, বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ও ফাইল শেয়ারিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরছেন তাঁরা। যেমন ‘দলিত ক্যামেরা অম্বেডকর’ নামে একটি ইউ টিউব চ্যানেল বা ‘দলিত অ্যান্ড আদিবাসী স্টুডেন্টস পোর্টাল’-এর মতো ফেসবুক পেজ। এ দেশে দলিতদের ‘বাস্তব’ পরিস্থিতিটা তুলে ধরাই এই সব চ্যানেল বা পেজের প্রধান উদ্দেশ্য।
নিজের ক্ষমতাবলে, পরীক্ষায় সফল হয়ে কোনও তরুণ শিক্ষানবীশ সাংবাদিক যদি বা নিউজরুমে ঢুকেও পড়েন, তাঁর কেরিয়ার গ্রাফটা ঠিক কেমন হয়? গত বছর ১২ এপ্রিল উত্তরটা দিয়ে গেলেন ৩৫ বছরের নাগরাজু কোপ্পুলা। না, রোহিতের মতো তাঁকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়নি, ফুসফুসে ক্যানসার সেই কাজটা অনেক ‘সহজ’ করে দিয়েছে। দক্ষিণের একটি নামজাদা ইংরেজি দৈনিকে সাংবাদিক ছিলেন তেলঙ্গনার খাম্মাম জেলার মদিগা সম্প্রদায়ভুক্ত কোপ্পুলা। তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম, যিনি কোনও ইংরেজি খবরের কাগজে কাজ পেয়েছিলেন। খবরের কাগজটির বিরুদ্ধে কোপ্পুলার বন্ধুদের অভিযোগ, সহকর্মীদের কটূক্তি, একই পদের সহকর্মীদের থেকে অনেক কম মাইনে, যোগ্যতার পরিচয় দেওয়ার পরেও মাইনে না-বাড়া, এই সব বিভিন্ন ধরনের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হতো তাঁকে। তবু টিঁকে ছিলেন, যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন প্রতিদিন। ক্যানসার এসে তাঁর সেই জীবন-যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। খবরের কাগজটির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, একদম শেষ অবস্থাতেও কোপ্পুলার পাশে এসে দাঁড়াননি তাঁরা। প্রভিডেন্ট ফান্ড-সহ নানা সুযোগ-সুবিধে থেকেও বঞ্চিত করা হয় তাঁকে।
নিউজরুমে দলিত সাংবাদিকরা থাকলেও কী ভাবে রয়েছেন, তার একটা খণ্ডচিত্র হয়তো তুলে ধরবে কোপ্পুলার এই জীবন কাহিনী। খণ্ড ছবি, নাকি খণ্ড নয়? আসলে, দলিত সাংবাদিকেরা সংখ্যায় এত কম কেন, এই প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু আমার-আপনার ‘চারদিকে এত সংরক্ষণ কেন রে বাবা’-মার্কা উল্টো-প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। শুধু নিউজরুম কেন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে চাকরি জীবনের বিভিন্ন ধাপে কত জন ‘দলিত’ আমার-আপনার বন্ধু বা সহপাঠী বা সহকর্মী? যদি বা কেউ থেকেও থাকেন, তাঁরা ‘সব মণ্ডল কমিশনের কৃপায়’ ভেবে প্রকাশ্যে না হলেও চাপা ‘উচ্চবর্গীয়’ হাসি কি কখনও আমি বা আপনি হাসিনি?
কত দিন এই ‘উচ্চবর্গীয়’ শ্লাঘা আমরা বা আমাদের সংবাদমাধ্যম আঁকড়ে ধরে থাকতে পারব, তা বলে দেবে ভবিষ্যৎ। তার আগে হাল আমলের একটা খবর দিই। বছর কয়েক আগে বিবিসি, সিএনএন-আইবিএন ও হিস্ট্রি ১৮ চ্যানেলের যৌথ ব্যবস্থাপনায় একটি অনলাইন সমীক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। thegreatestindian.in এই সাইটে গিয়ে ভোট দিতে বলা হয়েছিল এই বিষয়ে— মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর পরে সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় কে?
ভোটে জিতেছিলেন ভীমরাও রামজি অম্বেডকর!
ঋণ স্বীকার:
- Anisha Sheth, “The Death of a Dalit Journalist and the question of casteism in the Indian Media” in The News Minute, 27 April 2015.
- C Suresh Kumar and R Subramani, “Internet as an alternative media for Dalits in India: Prospects and Challenges” in IOSR Journal of Humanities and Social Science, Vol 19, Issue 2.
Comments (2)
-
Lekha ta khub i bhalo kintu swadhinotar 68 year poreo nijek dolit bola tao opomaner sujog neoa tao lojjar.
Dolit der niye sudhu politics i holo unnoyon ta holo na. Ar dolit der onek ei cast reservation ta nijeder odhikar mone kore boslo.
Cast system jotodin na utche totodin er theke nijeke mukto rakha ba mukti paoa kono tai sombhob noi.
খুব জরুরী বিষয়ে খুব ভাল লেখা, একথা গুলো কিয়দংশে জনজাতি, মুসলমান এবং মহিলাদের জন্যেও প্রযোজ্য।