আলোচনায় অ-বাক স্বাধীনতা
দেশদ্রোহী শব্দটা আর এই মুহূর্তে নতুন কিছু নয়। ইতিমধ্যেই তা মুহুর্মুহু বর্ষিত হয়েছে নানাজনের উপরে। এই নিয়ে চর্চাও কম হয়নি। গোটা বিষয়টিকে যদি একবার ফিরে দেখার চেষ্টা করা যায়, তাহলে তাতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল সংবাদমাধ্যমের। কারণ, জনমতের নির্মাণে সংবাদমাধ্যম এই মুহূর্তের পৃথিবীতে সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করে।
সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষ নয়, এ কথা নার্সারি স্কুলের পড়ুয়াও জেনে গিয়েছে আজ। এ আর নতুন কথা নয়। কোনও নির্দিষ্ট দলের স্বার্থ রক্ষা করে সংবাদমাধ্যম তাদের সংবাদ পরিবেশন করবে, এ কথা এখন ধ্রুব সত্য। এই নিয়ে আক্ষেপ করারও কিছু নেই। আর এ কথা সকলেই মেনে নেবেন যে চূড়ান্ত সত্য বলেও কিছু নেই। দৃষ্টিকোণ বদলে দিলে সত্যি-ও বদলে যায়।
বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে জনমত তৈরির অন্যতম পরিসর হলো প্রতি রাতের আলোচনাসভা। একদিক থেকে তা আমাদের দেশের অসহিষ্ণুতার প্রকৃত ছবি তুলে ধরে। কারণ, কেউই প্রায় কাউকে কথা বলতে দিতে চান না। এই লেখাটি একটি কাল্পনিক লেখা। যার শুরু এবং শেষের সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু মাঝখানের অংশটা একদমই অবাস্তব। কারণ, এখানে মাঝখানের কথোপকথনে বাধা ছাড়াই কথা বলতে পারেন আলোচনায় অংশগ্রহণকারী। আলোচনাসভায় অনেকে উপস্থিত থাকেন। এ ক্ষেত্রে আমি শুধুমাত্র সঞ্চালক এবং একজন আলোচনাকারীর কথোপকথনের কাল্পনিক অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আসুন, শুরু করা যাক।
সঞ্চালক: আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই আজকের আলোচনা অনুষ্ঠানে। আজকের আলোচ্য বিষয় ‘বাক-স্বাধীনতার নামে দেশদ্রোহিতা’। দর্শক-শ্রোতারা ইতিমধ্যেই অবহিত আছেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) সাম্প্রতিক দেশদ্রোহী স্লোগান-বিতর্ক নিয়ে। তার রেশ এসে পড়েছে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও। নেশন ওয়ান্টস টু নো, বাক-স্বাধীনতার নামে এই দেশদ্রোহ মেনে নেওয়া যায় কি না। আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন জেএনইউয়ের একজন ছাত্র। শুরুতেই তাঁর কাছে আমার প্রশ্ন। এখন তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, জেএনইউ দেশদ্রোহকে সমর্থন করে। এ বিষয়ে আপনার কী মত?
জেএনইউয়ের ছাত্র: জেএনইউ তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একটি প্রতিষ্ঠান তো কোনও কিছুকে সমর্থন বা বিরোধিতা করতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকা মানুষ নিজেদের মতামত দিতে পারেন। আপনারা তো শুরু থেকেই জেএইউ-কে দেশদ্রোহের সমর্থক বানিয়ে দিয়েছেন। আপনাদের হেডলাইন তো তেমনই বলে।
সঞ্চালক: যে দেশদ্রোহের স্লোগান সেখানে উঠেছিল, আপনাদের বড় অংশই তো তার পক্ষে মিছিল করছেন, সভা করছেন। তার কী কারণ? আপনারা তো দেশদ্রোহী!
জেএনইউ-র ছাত্র: দেশ বলতে আপনি কী বোঝেন? দেশদ্রোহ বলতে আপনি কী বোঝেন?
সঞ্চালক: আপনি প্রসঙ্গকে ঘেঁটে দেবেন না। দেশ মানে ভূখণ্ড, দেশ মানে তার আইন-কানুন, দেশদ্রোহ মানে দেশের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে যাওয়া এবং দেশের ধ্বংস চাওয়া।
জেএনইউ-র ছাত্র: দেশ মানে সব থেকে বড় করে দেশের মানুষ এবং সেই মানুষের জন্য তৈরি করা সংবিধান। আমাদের দেশের সংবিধানে বাক-স্বাধীনতার কথাও তো বলা হয়েছে।
সঞ্চালক: এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি, বাক স্বাধীনতার মানে কখনও এই নয় যে দেশের বরবাদি চাওয়া। আর যারা তা চায়, তারা অবশ্যই দেশদ্রোহের দায়ে দুষ্ট।
জেএনইউ-র ছাত্র: আপনার কাছে দেশের বিচারব্যবস্থা যখন সম্মানের বিষয়, তখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত দেশদ্রোহ নিয়ে যা রায় দিয়েছে আগে, তা নিশ্চয় আপনি মেনে চলবেন। সেখানে তো স্পষ্ট বলা হয়েছে, হিংসা না ছড়িয়ে শুধুমাত্র স্লোগান দেওয়ার কারণে কেউ দেশদ্রোহে দোষী প্রমাণিত হতে পারে না।
সঞ্চালক: আদালতের বিচারাধীন বিষয়টি আদালত অবশ্যই বিচার করবে। কিন্তু অভিযুক্তরা ভারতের বরবাদি চাইছে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলছে, আপনারা এই স্লোগানগুলো সমর্থন করেন?
জেএনইউ-র ছাত্র: অভিযুক্ত যারা, তারা এই স্লোগানগুলো দিয়েছে আপনি নিশ্চিত? যারা ভারতের বরবাদি চেয়ে স্লোগান দিচ্ছে, আপনাদের দেখানো ভিডিও ফুটেজে তো কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না। কোনও ছাত্র-সংগঠন তো সেই স্লোগানকে সমর্থনও করেনি। প্রত্যেকেই তো তার বিরোধিতা করেছে। তারপরেও জেএনইউয়ের সঙ্গে, সেখানকার কিছু ছাত্র-সংগঠনের সঙ্গে এই স্লোগানগুলো আপনারা জুড়ে দিচ্ছেন কেন? যে কাশ্মীরকে ভারতের অখণ্ড অংশ ধরা হয়, সেখানে এই স্লোগান উঠলে কি আপনারা গোটা দেশের সঙ্গে তা জুড়ে দেন? সেই স্লোগানকে কি গোটা দেশের স্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন? তাহলে জেএনইউ প্রাঙ্গণের মধ্যে অজ্ঞাতপরিচয় কেউ সেই স্লোগান তুললে তার সঙ্গে গোটা জেএনইউ-কে জড়িয়ে দেওয়ার যুক্তি কী? আর ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়ার অধিকার কারও আছে কি না, সেই প্রশ্নে না গিয়েও আপনারা যে ফুটেজ দেখাচ্ছেন দিনভর, তা নিয়েই তো সন্দেহ তৈরি হয়েছে। অনেকের কাছে তো তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত যে সে ভিডিও আসল নয়। উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তার মধ্যে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি ঢোকানো হয়েছে।
সঞ্চালক: আপনার প্রসঙ্গে আসবো, তার আগে ফোনে রয়েছেন একজন প্রাক্তন সেনাকর্তা। হ্যাঁ, বলুন আপনি।
প্রাক্তন সেনাকর্তা: এ আমাদের কাছে লজ্জার ঘটনা। অনুতাপের ঘটনা। যে ভারতের পতাকার জন্য আমরা এক বিন্দু না ভেবেও রণক্ষেত্রে আমাদের প্রাণ দিতে পারি, সেই ভারতে বসেই ভারতের বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে। এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে! আরও কষ্টের যে দেশদ্রোহকে সমর্থন করছে ছাত্রছাত্রী এবং এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরা। যে সন্ত্রাসবাদীরা ভারতের পার্লামেন্ট আক্রমণ করে এবং আটজন নিরাপত্তারক্ষীকে মেরে ফেলে, সেই সন্ত্রাসবাদীদের যারা সমর্থন করে, তারা দেশের শত্রু।
সঞ্চালক: প্রাক্তন সেনাকর্তার কথার প্রতিক্রিয়ায় আপনি কী বলবেন?
জেএনইউ-র ছাত্র: প্রতিক্রিয়া তো ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। ভারতের বরবাদি চাওয়ার স্লোগানকে সমর্থন করার প্রশ্নই নেই। দেশদ্রোহের অভিযোগে পুলিশের হেফাজতে থাকা ছাত্ররা কেউ এই স্লোগান দিয়েছে, তার প্রমাণ তো পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। আপনাকে বরং একটা প্রশ্ন করতে চাই। আজকাল বারবার দেখছি এই সংক্রান্ত আলোচনায় আপনি এবং আপনারা সব সময় কোনও না কোনও প্রাক্তন সেনাকর্তাকে দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ স্তম্ভ হিসেবে হাজির করেন। সেনারা আমাদের দেশের সীমান্ত রক্ষা করেন, দেশের মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য সদা সতর্ক। তাঁদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক— এঁরা কেউ দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ স্তম্ভ হওয়ার যোগ্য হন না? তাঁদের কাউকে আপনাদের অনুষ্ঠানে আনেন না কেন? আর সেনা হলেই যে বিশুদ্ধ মানুষ এমন কথারও তো কোনও প্রমাণ সব সময় মেলে না। মিললে তো শর্মিলা চানু নামটা এত পরিচিতই হতো না।
সঞ্চালক: আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন। সোজা কথায় উত্তর দিন, আপনারা কি কাশ্মীরের আজাদির পক্ষে?
জেএনইউ-র ছাত্র: কাশ্মীরের মানুষ আজাদি চাইবেন কি চাইবেন না, তা তো কাশ্মীরীদের বিষয়। আমরা তো তাঁদের হয়ে মতামত দিতে পারি না।
সঞ্চালক: কিন্তু আপনাদের ক্যাম্পাসেই তো কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি স্লোগান ওঠে।
জেএনইউ-র ছাত্র: এই আজাদির শ্লোগান তাদের আত্মনির্ধারণের পক্ষে সওয়াল করা। যে আত্মনির্ধারণের প্রতিশ্রুতি তারা পেয়েছিলেন ভারত রাষ্ট্রের থেকে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। উপরন্তু সেখানে যে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে, তা থেকে তাদের মুক্তি যে কোনও শুভবুদ্ধির মানুষেরই চাওয়া উচিত বলে মনে করি।
সঞ্চালক: কিন্তু আফজল গুরুর মতো একজন সন্ত্রাসীর পক্ষ নিয়ে কথা বলা কী ভাবে সমর্থনযোগ্য বলে আপনার মনে হয়?
জেএনইউ-র ছাত্র: আফজল গুরুর বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানেই আফজল গুরুর সমর্থন কী ভাবে হয়, সেটাই তো মাথায় আসছে না। আফজল গুরুর বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্ন করা মানে তাকে নিষ্পাপ বলাও তো নয়। এবং তার বিচারপ্রক্রিয়া এবং মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা তো এই প্রথম নয়। বহু বিশিষ্ট লোকই তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সঞ্চালক: আদালতের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা আপনারা কী ভাবে করেন?
জেএনইউ-র ছাত্র: তাহলে তো ৩৭৭ ধারা নিয়েও কথা বলা উচিত নয় কারও।
সঞ্চালক: আমাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে। আজকের আলোচনাতেও বারবার প্রমাণিত হচ্ছে জেএনইউ দেশবিরোধী শক্তিকে মদত দেয়। তারা দেশদ্রোহের পক্ষে সওয়াল করে। নেশন ওয়ান্টস টু নো……
নেশনের আর অন্যদের বক্তব্য জানা হয় না, এটাই আফশোস!
Comments (3)
-
যদি পরিসর ও সময় দুটো বেশি হতো আরো ভালো হতো…..
-
সরস, সুন্দর লেখা। জরুরি প্রশ্ন।
নেশন ওয়ান্টস টু নো…অর্ণব গোস্বামীর মতো ‘পোতিভাবান’ ‘সঙ’বাদিক কীভাবে দেশপ্রেমের কপিরাইট পেলেন?!!