খবরের ভূগোল: সেকালে একালে
কানাইদার খবরের কাগজ পাঠের প্রভাতী আসরে (‘খবরের মেয়ে, মেয়েদের খবর’ 22nd January 2016) নিয়মিত হাজির থাকতো শঙ্করদা এবং তাঁর একনিষ্ঠ চেলা কাম অ্যাসিস্ট্যান্ট ভোলা। মিষ্টির দোকানের পাশেই শঙ্করদার চুল কাটার সেলুন। ভোলাদাকে অ্যাপ্রেনটিস হিসেবে নিজের গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে এসেছে শঙ্করদা, ট্রেনিং দিয়ে ফুল ফ্লেজেড ‘নরসুন্দর’ বানাবে। দাদা-কাকাদের চুলে ভোলাদার হাত দেওয়ার অনুমতি নেই। ভোলাদা আমাদের মতো বালখিল্যদের মাথাতেই হাত পাকাচ্ছিল, আর কানাইদার সংবাদ ভাষ্যের ওপর শঙ্করদার টীকার সহায়তায় বিশ্ববীক্ষা তৈরি করছিল। একদিন চুল কাটতে কাটতে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করে বসল, “হ্যাঁগো, এখানে আসার আগে তোমরা কোথায় যেন থাকতে?” আমি বললাম, “আসামে।” ভোলাদা এবার শঙ্করদাকে পাকড়ালো, “আসামটা ঠিক কোনদিকে?” শঙ্করদা বুবলাদার দু’ধারের জুলপি মাপতে মাপতেই উত্তর দিল, “ওই আসানসোলের ওধারে।” দুটো জায়গার নামের মধ্যে একধরনের ধ্বনিগত মিল যখন আছে তখন উত্তরটা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হল ভোলাদার। আমার প্রতি বছরে একবার তিনদিন ধরে লাগাতার চলে, তিনবার ট্রেন এবং দুবার স্টিমার বদলে বাড়ি আসার অভিজ্ঞতার অহঙ্কার এক মন্তব্যেই চুরমার। (অনেক পরে সত্যজিৎ রায় ‘অশনি সঙ্কেত’-এ প্রায় একই ধরনের একটা সংলাপ ব্যবহার করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে বোমা পড়েছে এই খবর শুনে এক গ্রামবাসী তাঁর প্রতিবেশীকে জিজ্ঞেস করছেন, সিঙ্গাপুরটা কোথায়, আর তিনি বলছেন ওই মেদিনীপুর পেরিয়ে)। কানাইদার সংবাদ পাঠের প্রভাতী আসরে বম্বে দিল্লি থাকত, খেলার পাতার সুবাদে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াও জানা যেত, হিন্দি সিনেমার দৌলতে কাশ্মীরও জানা ছিল ভোলাদার। কিন্তু অসম? সংবাদ মাধ্যমে ‘বঙ্গাল খেদা’ জাতীয় বড় ধরনের গোলমাল না হলে অসমের কোনও খবর থাকতো না। যদিও সেখানে তখন অনেক বঙ্গভাষী থাকতেন, দু’দিনের বাসি হলেও নিয়মিত বাংলা কাগজ পড়তেন তাঁরা।
কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে কোনও অঞ্চলের গুরুত্ব বোঝাতে কোনও দেশের ম্যাপকে আনুপাতিক হারে ছোট বা বড় করে আঁকার পদ্ধতিকে বলা হয় কার্টোগ্রাম। ধরুন, যদি দরিদ্র পৃথিবীর কার্টোগ্রাম আঁকতে চান তাহলে দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকা অনেক বড় করে আঁকতে হবে, আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ বা জাপান গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে যাবে। আবার ধনী পৃথিবীর কার্টোগ্রাম আঁকতে গেলে ঠিক উলটে যাবে দেশগুলোর আয়তন। আমার কৈশোরের পশ্চিমবঙ্গের ‘সংবাদ-মাধ্যম-প্রদত্ত’ গুরুত্বের অনুপাতে যদি ভারতের একটা কার্টোগ্রাম আঁকা যেত, তাহলে প্রতিবেশী অনেক রাজ্যকেই দেখা যেত না সেখানে। প্রশ্নটা তুললে এখনও যে উত্তরটা পাই সেটা হল, “আরে ধুর ধুর, ওসব বুনো, পিছিয়ে পড়া জায়গার খবরে তখন কার কী ইন্টারেস্ট থাকতো বলতো? তাছাড়া, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মতো ছিল না কি? খবরটবর পাওয়া, যাচাই করা বেজায় কঠিন ছিল। অত ম্যাপ ধরে হিসেব করে খবর তৈরি হয় না ভাই।” হক কথা। অতএব যা কাগজে নেই, তা প্রভাতী প্রার্থনায় নেই, তা শঙ্করদার মাথাতেও নেই, ভোলাদা তাদের জানে না…… প্রকৃতি, ঈশ্বর, মানুষ সবারই “শূন্য না-পসন্দ” – দেশের ফাঁকা জায়গাগুলো নিজের মতো নির্মাণ করে নিয়েছিল ভোলাদা – রাজবংশী, কোচ, মেচ, রাভা, নেপালি, অসমীয়া, নাগা, মিজো…… ফরাক্কার ওপার থেকে মায়ানমারের সীমান্ত অবধি সমগ্র কিরাতকূল হল ‘নেপালি’ বা ‘চিনেম্যান’, তামিল, মালয়ালি, তেলুগু আর কন্নড়ভাষী সবাই ‘মাদ্রাজী’, দ্বারভাঙ্গা থেকে কচ্ছের রান পর্যন্ত যে কোনো জায়গা থেকে আসা হিন্দিতে কথা বলা মানুষেরা কায়িক শ্রম করলে ‘খোট্টা’ আর মানসিক শ্রম করলে ‘মেড়ো’, দাড়ি আর পাগড়ি থাকলে ‘পাঁইয়া’, পাগড়িহীন দাড়ি হলে ‘নেড়ে’। আর ‘নিষাদ’-রা সবাই সাঁওতাল; এই সব নিয়ে ভারত। ভোলাদা ভিয়েতনাম জেনে গেছিল, মিছিলে স্লোগান শুনে শুনে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও জানতো, এসব নিয়ে পাড়ার মোড়ে মাঝে মধ্যেই স্ট্রিট কর্নার মিটিং হতো, শঙ্করদার দোকানের এক্কেবারে সামনে।
পৃথিবী এখন গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে বৈদ্যুতিন যোগাযোগ ব্যবস্থায়। পাশের বাড়ির মাসিমার সঙ্গে কথা বলা, আর সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারে বাস করা ভগ্নিপতির সঙ্গে কথা বলা একই ব্যাপার। অতএব খবর পেতে অসুবিধা আর নেই। এখন কি খবরের অনুপাতের ভিত্তিতে আঁকা ভারতের কার্টোগ্রাম অন্যরকম হবে? বলা মুশকিল! হিসেব মতো ভারতের ‘রেজিস্ট্রার অফ নিউজপেপারে’র কাছে নিবন্ধীকৃত হয়েছে প্রায় এক লক্ষ পত্রপত্রিকা। টিভি চ্যানেল আছে প্রায় ৯০০, তার মধ্যে ৩০০টি নিজেদের সংবাদ চ্যানেল হিসেবে ঘোষণা করেছে। ছোট-বড় সব রকম মাধ্যম মিলে প্রচারিত খবরের ভিত্তিতে দেশের একটা সঠিক কার্টোগ্রাম পাওয়া যায় কিনা, সেটা কেউ চেষ্টা করে দেখছেন বলে জানা নেই আমার। তবে জাতীয় দৈনিকগুলো পড়লে মনে হয় খুব কিছু পান্টায়নি আমার কৈশোরের সময় থেকে।
সব পেয়েছির দেশ, গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী আমেরিকায় এরকম একটা চেষ্টা করেছিলেন সেখানকার মিডিয়া জগতেরই এক দিকপাল, ‘পাবলিক রেডিও ইন্টারন্যাশনাল’ এর প্রধান এলিসা মিলার। ফেব্রুয়ারি ২০০৭-এর সবক’টা আমেরিকান নেটওয়ার্ক আর কেবল নিউজ চ্যানেলে পরিবেশিত তথ্যের ভিত্তিতে একটা কার্টোগ্রাম তৈরি করে দেখিয়েছিলেন ‘সব দেশের গার্ডিয়ান’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সব খবর মিলে ৭৯ শতাংশ জায়গা দিয়েছিলেন নিজের দেশকে – বাকী ২১ শতাংশের সিংহভাগ জুটেছিল ইরাকের – চিন, ভারত, রাশিয়া সম্মিলিত ভাবে পেয়েছিল ১ শতাংশ। মাসটা আন্তর্জাতিক খবরের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়েই প্যারিসে উষ্ণায়নে মানুষের ভূমিকা নিয়ে নির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেছিলেন আই পি সি সি, উত্তর কোরিয়া তাদের পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডার বিনষ্ট করবে বলে ঘোষণা করেছিল, প্রবল বন্যায় ভেসে গিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। এসব বিশেষ পাত্তা পায়নি খবরে। এই চ্যানেলগুলো ছাড়াও ডিজিটাল মিডিয়ার হাল দেখাতে মিলার উল্লেখ করেছিলেন পিউ (PEW) গবেষণা কেন্দ্র এবং কলম্বিয়া স্কুল অফ জার্নালিজমের একটি যৌথ গবেষণার। তাঁরা গুগল নিউজের প্রথম পাতার চোদ্দ হাজার রচনার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন যে সেগুলি আসলে সেই সময়ে সবকটি চ্যানেলে বহুচর্চিত ২৪টি খবরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। ডিজিটাল মিডিয়াও আসলে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস আর রয়টার্সের বহু চর্বিত খবরগুলোই ঈষৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চালাচ্ছে। মিলার প্রশ্ন তুলেছিলেন আমেরিকাবাসীরা, যাঁরা নিজেদের বিশ্বশুদ্ধ সবার ওপর খবরদারি করার অধিকারী বলে মনে করেন, তাঁদের বহির্বিশ্ব নিয়ে কৌতূহলের এই যদি নমুনা হয়, তাহলে সত্যিই কি তাঁরা অন্য দেশের গণতন্ত্রের মান নিয়ে খবরদারি করতে উৎসাহী বলে ধরতে হবে? ভোলাদার থেকে তাঁরা আলাদা কীসে বুঝলাম না!
এই নিয়ে বিচলিত হবার তেমন কিছু নেই বটে; দুনিয়ার সব খবর জেনে ফেলা কারও পক্ষে সম্ভব নয়, তার প্রয়োজনও হয়তো নেই! কিন্তু ভোলাদারা কীসে উৎসাহী হবে, সব কিছু সেই স্তরেই রেখে দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? ভোলাদার কী জানা উচিত, সেটা কি ভাবা হবে না? কথায় কথায় কেরলের মানবোন্নয়নের উদাহরণ রাখা হবে, অথচ অনেক কম সম্পদ নিয়ে, অনেক বেশি সমস্যা মাথায় নিয়ে ছোট্ট মণিপুর যে মেয়েদের ক্ষমতায়নে কিংবা শিশুমৃত্যুর হারে কেরলের থেকে এগিয়ে গেছে, সে গল্পটা কেবল গবেষকরা জানবেন? আর একটা উদাহরণ মনে পড়ছে। ২০১৫-র ১৩ই নভেম্বর ‘ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট’ (আইসিল)- এর সন্ত্রাসবাদীরা প্যারিসে ১৩০জনকে হত্যা করল। পরের দিন পশ্চিমি দুনিয়া এবং অ-মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর অধিকাংশ ছোটবড় সব সংবাদ মাধ্যমে এটাই ছিল মুখ্য খবর। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, চিন, অনেক অনেক দেশ ফ্রান্সের সঙ্গে সহমর্মিতায় নিজেদের দেশের প্রধান সৌধগুলো ফ্রান্সের পতাকার রঙে রাঙিয়ে ছিল। আমদের দেশেও সব বড় মাধ্যমে বিপুল জায়গা ও সময় জুড়ে পরিবেশিত হয়েছিল খবরটা। ফেসবুকে দেখছিলাম, বন্ধুরা নিজেদের প্রোফাইল ছবিতেও ফ্রান্সের পতাকার রঙ লাগিয়েছেন। এই মানবিক সহমর্মিতা ভাল লেগেছিল অবশ্যই, তবু একটা ছোট ‘কিন্তু’ খচখচ করছিল। প্যারিস বিস্ফোরণের ঠিক ৩৬ ঘন্টা আগেই আইসিল-এর আত্মঘাতী জল্লাদরা একই ধরনের আক্রমণ চালিয়েছিল বেইরুটে, হত্যা করেছিল জনা চল্লিশেক নিরপরাধ লেবাননবাসীকে, এরও বারো দিন আগে, ৩১শে অক্টোবর, ২০১৫ তে সিনাই পাহাড়ে রাশিয়ার একটি প্লেন ভেঙে পড়ে আইসিল-এর রাখা বোমা বিস্ফোরণে; মারা গেছিলেন ২১৭ জন যাত্রী আর ৭ জন ক্রু। আরও কিছুদিন আগে ১০ই অক্টোবর, তুরস্কের আঙ্কারা শহরে একটি শান্তি মিছিলকে আক্রমণ করেছিল আত্মঘাতী আতঙ্কবাদীরা, মারা গেছিলেন শতাধিক শান্তিকামী নাগরিক। এর পেছনেও আইসিলের হাত আছে বলে তুরস্ক সরকারের ধারণা।
লেবানন, রাশিয়া, তুরস্ক— একটা দেশেরও ম্যাপের রঙ লাগেনি পশ্চিমি দুনিয়ার অথবা আমাদের কোনও সৌধে, কারও প্রোফাইল পিকচারে। পশ্চিমি দুনিয়ার অথবা আমাদের দেশের কাগজে কত কলম সেন্টিমিটার জায়গা পেয়েছিল, কত ফন্টের হেডলাইন জুটেছিল এই খবরগুলোর, অথবা দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে কতক্ষণ দেখানো হয়েছিল সেগুলো, মনে করতে পারছি না। ফ্রান্সের ঘটনার তুলনায় কিছুই না। ফ্রান্স যতটা জায়গা পেল আমাদের সংবাদ মানচিত্রে, বাকি দেশগুলোর কেন তার অর্ধেকও জুটল না? কেন সেখানকার মানুষের জন্য আমাদের সহমর্মিতা এত ‘বাড়ন্ত’?
উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিবাসী এক প্রাক্তন সহকর্মী ভগ্নী আমার এই সরল বোকা-বোকা প্রশ্নের উত্তরে ঠোঁট টিপে হেসে বলল, “লোকেশন দাদা, লোকেশন। ঔপনিবেশিক অভ্যাস অনুযায়ী সাহেবসুবো ছাড়া অন্য কারুর জন্য আমাদের স্টকে কোনও সমবেদনা নেই। নাহলে কী আর কেবল চ্যাপ্টা নাকের জন্য আমার রাজ্যের লোককে দিল্লিবাসীরা পিটিয়ে মারে বিনা অনুশোচনায়!” এটা কি ইচ্ছাকৃত, নাকি পশ্চিমকে অলস অনুসরণের অভ্যাস মাত্র? আইসিল যে কেবল সাহেব বলি দিচ্ছে না, তাদের আক্রমণে মুসলমান ধর্মাবলম্বীরাও প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক বড় সংখ্যায়, এই তথ্যটা খণ্ডিত মানচিত্রে হারিয়ে যাচ্ছে কি? আমাদের দেশের দুই প্রধান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে উঁচু বেড়াটা তুলতে উঠেপড়ে লেগেছে দু’পক্ষের মৌলবাদীরা, এই ভাঙা কার্টোগ্রাম কি সেটাকে আরও মজবুত করছে না? সবগুলো খবর একই গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত না হলে ভোলাদারা যে ম্যাপটা বানাচ্ছে মনে মনে, তাতে দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীরা শত্রু হয়ে উঠছে না কি?
কে জানে?
Leave a Reply