বসন্ত বিলাপেও হিলারি-ট্রাম্প
সপ্তাহান্তে দুপুরে মাংসভাত খেয়ে সবে ল্যাপটপে নস্ট্যালজিয়া উস্কে বসন্ত বিলাপ দেখা শুরু করেছি। সৌমিত্র গাইছেন, লেগেছে লেগেছে আগুন.. হঠাৎ ঢুকে পড়লেন ট্রাম্প। মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই এলসিডি স্ক্রিনে হিলারির আবির্ভাব। নির্বাচনী বিজ্ঞাপন। মজার ব্যাপার হল, হিলারির ছবি দেখে যে বিজ্ঞাপনটাকে ডেমোক্র্যাটদের ভেবেছিলাম, সেটা আসলে ট্রাম্পের। আর ট্রাম্পেরটা হিলারির।
এখন এখানে ‘ফল’—পাতা ঝরার মরসুম। চারিদিকে রঙের মেলা। কনকনে হাওয়া বইছে। সকাল বিকেল হাওয়ায় নাক টেনে দেখেছি এখানে ভোটের কোনও গন্ধ নেই। ভারতে যেমন ভোটের হাওয়া বলে একটা ব্যাপার আছে। এই যেমন রাস্তাঘাটে নতুন করে একপ্রস্ত পিচ ঢালা, দেওয়ালে দেওয়ালে নানারঙের লিখন এবং পোস্টারের সমারোহ—সেটা আমেরিকায় নেই। মাস দুয়েক হল আমেরিকায় এসেছি । এই ক’দিনে ভোট নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। আমাদের মতো এখানে মানুষ জানে না ভোটের ঢাকে কাঠি পড়া জানিসটা কী! ঢাক নেই কাজেই ঢাকগুড়গুড়ও অনুপস্থিত। কিন্তু কাঠি আছে। ডেমোক্র্যাট ক্যান্ডি হিলারি আর রিপাবলিকান ক্যান্ডি ট্রাম্প পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্রমাগত কাঠি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে সেই কাঠি যে বসন্ত বিলাপেও গুঁজে দেওয়া হবে কে জানত।
এবার এখানে বিজ্ঞাপনের কায়দাটাই এরকম।
প্রতিদ্বন্দ্বীর ছবি বার বার দেখিয়ে ভোটারদের বোঝাও, এই লোকটা। এই লোকটা। এই লোকটাই অপদার্থ। প্রতিপক্ষের ছবি দেখানোর জন্য এমন তারিকার নজির আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে রয়েছে কি না সন্দেহ! ২০১৬-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে বলা হচ্ছে, ইতিহাসের সবচেয়ে ‘নেগেটিভ ক্যামপেনে’র ভোট। বোধকরি সেই সেই নেতিবাচক প্রচারের রকমসকম এমনই। অর্থাৎ আমি পারব কি পারব না সেটা বড় কথা নয়। ও পারবে না সেটা ভাই আগে থেকেই বলে দিচ্ছি। অতএব ও যখন পারবে না তখন আর রইলটা কে? সেই আমি। আমাকেই আমেরিকাবাসীর জন্য খাটতে হবে।
ছোট আমির কথায় আসি। আমি যে এখানকার ভোটার নই, সে তো আর ডেমো, রিপা’র প্রচারকর্তারা জানেন না। ফলে এ বাড়ির চিঠির বাক্স ভরে উঠছে যুযুধান দুই দলের প্রচারপত্রে। সেখানেও ভাবসাব একইরকম। হিলারির মস্ত ছবি দেওয়া কার্ড আসলে ট্রাম্পেরই প্রচারপত্র। কোথাও লেখা, ‘হিলারি বিক্রি আছে।’ তো কোথাও ‘হিলারি কিচ্ছু পরিবর্তন করতে পারবে না’।
নির্বাচনের লাস্ট ল্যাপে এসে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একের পর এক যৌনকেচ্ছা মাথাচাড়া দিচ্ছে। ‘মিডিয়া মজ’ অবশ্য কর গুনতে শুরু করেছে অনেকদিন থেকেই। আব তক ইগারা। এগারোজনকে নিয়ে নানা গুজব-অর্ধসত্য-আংশিক সত্য-খাঁটিসত্য শোনা যাচ্ছে। কোথাও মডেলেরসুন্দরীর সঙ্গে ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে , এর সঙ্গেই যত লটঘট। আবার কেউ দাবি করছেন, ট্রাম্প নাকি তাকে রাত কাটানোর জন্য দশ হাজার ডলারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
আবার ট্রাম্পপন্থীরা হিলারিরি বিরুদ্ধে দেশ বেচে দেওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে ভোটারদের মনে একধরনের সংশয় তৈরি করার চেষ্টায় রয়েছেন। তিনি এলে চাকরির সংকট আরও বাড়বে। এমন এক আশঙ্কাও তৈরি করা হচ্ছে। এফবিআই নতুন করে হিলারির ইমেল অ্যাকাউন্ট নিয়ে ফের তদন্ত শুরুর কথা ঘোষণা করায় সেটাও জোরাল ইস্যু হয়ে উঠছে ক্রমশ।
কে জিতবেন কে হারবেন সেই স্পেকুলেশন নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য অনেক লোক রয়েছেন। তা ছাড়া আমার মনে হয়, এখানকার ভোটরঙ্গে ভোটারদের মেরুকরণও নির্বাচনের আগে বেশ বোঝা যায়। কে জিততে চলেছেন গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দেয় সিএনএন, ফক্স, এবিসির মতো সংবাদ মাধ্যমগুলো। যদিও সে সব সমীক্ষার দাবি। না আঁচালে কোনও কিছুরই বিশ্বাস নেই।
এবারেই যেমন। নির্বাচনের এখনও বেশ কয়েকদিন বাকি। সমীক্ষায় না কি দেখা গিয়ছে, হিলারি ক্লিন্টন এগিয়ে রয়েছেন পাঁচ শতাংশ ভোটে।তা রপরেই এফবিআইয়ের তদন্ত শুরুর ঘোষণায় খেলা জমে গিয়েছে। তাহলে কি এ এই খবরের জেরে হিলারি ধাক্কা খাবেন? সে কথা ভোটবাক্সই বলবে। ভোটের ফলাফলের জন্য আমাদের ধৈর্য ধরতেই হবে।
এবার যেটা আমার কাছে বেশ নতুন মনে হয়েছে, সেটা হল নির্বাচনকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ার দবদবানি। এবার যেন আমেরিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পুরোটাই সৌশ্যাল মিডিয়াতেই হচ্ছে। ২০১২ নির্বাচনেও এমনটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সেবার দেশে খবর কাগজের দফতরে বসে আমেরিকার নির্বাচনের উপর নজর রাখতে গিয়ে দেখেছিলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছুকিছু খবর আসছে। বেশিরভাগই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ওয়েবসাইট এবং টেলিভিশনের খবর। এবার যেন হুড়মুড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে পড়েছে নির্বাচন সংক্রান্ত খবরাখবর। এ ক্ষেত্রে এটা বলা নিষ্প্রয়োজন, সমস্ত খরবর ত আর নিখাদ খবর হয়ে আসে না ফেসবুক বা হোয়্যাটসঅ্যাপে। এমনকী, ফেসবুক-টুইটার-হোয়্যাটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর কাছে সেইসমস্ত পোস্টের খুব দায়বদ্ধতা রয়েছে, তা নয়।
প্রশ্ন হল, এমনটা হওয়ার কারণ কী?
মাস ছ’য়েক আগের কথা। একটি গণমাধ্যম সংস্থা জানাল, এবার আমেরিকার ৪৪ শতাংশ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সংক্রান্ত খবর জানতে পেরেছেন।
তথ্যটা ততটা নিরীহ নয়, যতটা মনে হচ্ছে।
আমেরিকার মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। অর্থাৎ যত মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন (৮৭%) তাদের অধিকাংশই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক থেকেই খবরগুলো জেনেছেন। এই প্রবণতা, কিছুটা হলেও সজাগ করতে পারে আমেরিকার খবরের কাগজ বা প্রোথিতযশা নিউজ চ্যানেলগুলোকে। মানে, যদি সোশ্যাল মিডিয়াই খবরের জন্য পাঠকদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তবে তাদের আর প্রয়োজন কোথায়? কী হবে ‘তথ্যভিত্তিক’, ‘বস্তুনিষ্ঠ’ খবর বেচে?
সোশ্যাল মিডিয়ার বোলবোলাওয়ের পিছনে অর্থনীতির সাধারণ সূত্র এবং ভোটারদের মধ্যে সোশ্যালমিডিয়া প্রীতির ছকটাও বোঝা দরকার। বিশ্বে এখন প্রায় ১৯৬ কোটি মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। তারমধ্যে প্রায় দেড়শো কোটি লোক ফেসবুক ব্যবহার করেন। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে বড় অংশের বাস উত্তর আমেরিকায়। সুতরাং এই অঙ্কই বলে দিচ্ছে কোন রাস্তা ধরবেন ভোটপ্রার্থীরা।
বাস্তবিক। যাঁকে সোশ্যাল মিডিয়ার রাজা বলা হচ্ছে, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার কৌশলের অনেকটা জুড়েই ছিল সোশ্যাল মিডিয়া। শুধু যে তিনিই ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন এবং টুইট করে গিয়েছেন অবিরাম তা-ই নয়। তাঁর সমর্থকদের পক্ষ থেকে টেক্সট, ভিডিও, ছবি, হ্যাশট্যাগ, ইন্টারনেট মিম, নানা রকম উপায়ে ইতি-নেতি প্রচার করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধেও কম হয়নি।
এদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন সংবাদপত্র দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়শিংটন পোস্ট এবং দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের বিভিন্ন সমীক্ষায় সহায়তা করে এমন একটি পেশাদার সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট সংস্থা জানাচ্ছে, যে পরিমাণ প্রচার ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পেয়েছেন তার মূল্য ৩৮ কোটি মার্কিন ডলার। সস্তায় প্রচারের মাধ্যম বলতে এখন সোশ্যাল মিডিয়াকেই বোঝে মানুষ। বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যদি তাদের পণ্য বা পরিষেবার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারস্থ হতে পারে, তবে হিলারি বা ট্রাম্প কী দোষ করলেন?
আমেরিকার প্রায় ৩২কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মিলেনিয়ালস অর্থাৎ ১৬ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণতরুণীদের ৯০ শতাংশেরই অন্তত একটা সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এরাই ফেসবুক, হোয়্যাটস অ্যাপের বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী। এদের কাছে পৌঁছনোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা ছিল এটাই।
এবার প্রশ্ন তাহলে, সোশ্যাল মিডিয়া কি চিরাচরিত মিডিয়াকে পিছনে ফেলে দিল? অনেকে বলছেন, মিডিয়া এখন সোশ্যাল মিডিয়ার পিছনে। কথাটা খুব ভুল নয়। ফেসবুক, টুইটারের পোস্ট থেকে এখন অনেক খবরই তুলে ধরা হচ্ছে খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের পর্দায়। মিডিয়াবেত্তাদের ব্যাখ্যা অবশ্য, কে কার পিছনে ছুটছে সেটা বড় কথা নয়। এভাবে বিভিন্ন মিডিয়া যদি পারস্পরিক আদানপ্রদানের পরিমাণ বাড়ায়, তবে আখেরে সকলেরই লাভ। এতে মিডিয়াই জোরদার হয়।
তবে, এখানে একটা প্রশ্ন থাকছেই। প্রশ্নটা বিজ্ঞাপনের। এই প্রশ্নে কিন্তু কিছুটা হলেও পিছু হঠতে শুরু করেছে খবরের কাগজ। বিজ্ঞাপন বাবদ তাদের আয় কমছে সারা পৃথিবীতেই। বিজ্ঞাপনদাতারা সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে সঙ্গত কারণেই ঝুঁকছেন। আগামিদিনে সেটা একটা চিন্তার বিষয় অবশ্যই।
অতএব নতুন পুরনোর সেই দ্বন্দ্ব,। এই দ্বন্দ্বে সত্যিই পুরনোরা পিছু হঠছে কি না, এই মুহূর্তে এৱ সোজাসাপ্টা উত্তর হয়তো নেই। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব ক্রমবর্ধমান। ভালমন্দ দুই-ই রয়েছে। এত সহজে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আর কোথায়-ই বা আছে? আবার কারও বিরুদ্ধে অপপ্রচার করার ক্ষমতাও এর কম নয়। যেহেতু এর দায়বদ্ধতার জায়গাটা বেশ পলকা, অতএব এর মাধ্যমে সামাজিক ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যায়।
Leave a Reply