নেতৃত্ব নয়, চিন্তার মাধ্যম হোক মিডিয়া
আমাদের সামনে অনেক সমস্যা। কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, কোনটাকে কম তা ব্যক্তিগত স্তরে নানান আঙ্গিকে নির্ধারণ করা গেলেও সামগ্রিক স্তরে বিশেষ সমস্যায় পড়তে হয়। এই যেমন কাশ্মীরে ছিয়াশি জনের মৃত্যুতে শোক করা যাবে না, কারণ তারা অধিকাংশই বদ মতলবে বা পাক জঙ্গিদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দিকে ইটপাটকেল ছুড়েছিল। অতএব বিচ্ছিন্নতাবাদী, দেশদ্রোহী। অন্যদিকে উরি সেক্টরে জঙ্গি আক্রমণে সতেরোজন সেনাজওয়ান খুন হলেই দেশজুড়ে দেশপ্রেমের বন্যা বয়ে যাবে। ‘দেশপ্রেম’ ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের বিশেষ সমস্যা নেই। কারণ, আমরা আদপেই দেশদ্রোহী নই। নিজেদের জন্মভূমিকে ভালবাসি। শ্রদ্ধা করি তার মাটির উপর খেটেখুটে হা ক্লান্ত হওয়া মানুষজনকে। তাঁদের কেউ জঙ্গির গুলিতে উড়ে গেলে আমাদের একটা নাছোড় ঘৃণা আছড়ে পড়তেই পারে। তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু অবাক লাগে যখন দেখি ছিয়াশি জন সাধারণ কাশ্মীরবাসীর মৃত্যু নিয়ে আমাদের কোন চিন্তা নেই।
চিন্তা না-ই থাকতে পারে। কিন্তু যাঁদের উপর মানুষকে চিন্তিত করানোর দায় বর্তায়, তাঁরা যদি অন্যরকম ভূমিকা পালন করেন তবে দুশ্চিন্তা বাড়ে। আজকাল গোলাগুলি চললেই বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে কিছু প্রাক্তন সেনাঅফিসার এসে যুদ্ধের কৌশল শেখান। বিষয়টিকে আলোচনার স্তরে এমনভাবে সমস্যায়িত করা হয় যে কেউ আলটপকা অন্য কিছু বলার সুযোগই পাবেন না। বললেও সজোরে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হবে। জনমতকে গড়েপিটে নেওয়ার এ একটা খেলা। শুধু বৃহৎ কোন সমস্যার ক্ষেত্রেই যে এমনটা হচ্ছে, তা নয়। সব ক্ষেত্রেই একই ব্যাপার। ধরা যাক, কলকাতার অটো অত্যাচার সংক্রান্ত কোনও আলোচনা। সেখানে সবাই মিলে অটোচালককে গালিগালাজ করে যান একতরফা। অটোচালক ‘গরিব’ বা ‘ইউনিয়নবাজির সমস্যা’ ইত্যাদি কথা বলাই যাবে না।
ব্যাপারটা এমন নয় যে কোন অদৃশ্য সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ আছে। অথচ একমাত্রিক জনমত তৈরির চেষ্টা চলছে। এটাকে ঠিক ‘manufacturing consent’ গোছের গ্রামশীয় ব্যাখ্যা দিতে পারলে ভাল হতো। দেওয়া যাচ্ছে না এইজন্যই যে এর নির্দিষ্ট কোনও উদ্দেশ্যও নেই। অর্থাৎ রাষ্ট্র, বড়লোক বা সুবিধাভোগীদের হাত শক্ত করার জন্য বিশেষ ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলছে এমনটা নয়। একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছাঅনিচ্ছার উপর নির্ভর করেই পুরো মিডিয়া ব্যবস্থাটি পরিচালিত হচ্ছে। সর্বত্র নয়। কোথাও কোথাও।
এরকমটা চলতেই পারতো। কিন্তু কখনো কখনো প্রকৃত সত্যকে বোঝার উপাদানগুলিকে একেবারে অগ্রাহ্য করে ফেলে সমস্যা উপস্থাপনেও ঘাটতি থেকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমার চিন্তার একেবারে বিপরীত চিত্রটি আচমকা উপস্থিত হলে তাকে সামলানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। তখন একটা ভারসাম্য আনার জন্য উল্টোদিকে এতদূর যেতে হয় যে তা হাস্যকর হতে বাধ্য।
এরকমটা না করে প্রতিটি বিষয়কে নির্দিষ্টভাবে সমস্যায়িত করে উপস্থিত করাই উচিত। এর উপায় হল বিষয়টি সম্পর্কে অতিদ্রুত কোন স্থির ধারণায় না পৌঁছে তার সমস্ত দিকগুলি ভাল ভাবে বোঝার চেষ্টা করা। প্রতিটি দৃষ্টিকোণকে একইরকম ফুটেজ দেওয়া। দর্শককে চিন্তা করতে বাধ্য করা। একমাত্র সেভাবেই সম্ভব একটি স্বাধীন জনসমাজের প্রকৃত জনমত গড়ে তোলা। অবশ্য তার জন্য পরিশ্রম করতে হবে। বুঝতে হবে কেন কানহাইয়া কুমার বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হল ‘Critical Learning’এর জায়গা। ফাঁকিবাজেরা অবশ্য এসব কথাকে ‘দেশদ্রোহী’ বলবেই। কাশ্মীর নিয়ে আবার ‘Critical Learning’ কী? অত পড়াশোনা করে কাজ নেই।
Leave a Reply