অঙ্ক থেকে সাবধান! মিডিয়ায় মোড়লগিরি
ক্রেনিয়াস গ্রহের এক বাসিন্দাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল মানুষ সম্বন্ধে একটি যথাযথ রিপোর্ট দেওয়ার জন্য – যাতে সেটা পড়ে কোনও দিন মানুষ দেখেনি এমন যে কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ কেমন জীব তার একটা আন্দাজ করতে পারে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, একজন গড়পড়তা মানুষের একটি স্তন এবং একটি অণ্ডকোষ থাকে।
চট করে মনে হতে পারে ক্রেনিয়াসবাসীটা একটা গাধা, মানুষ সম্পর্কে কিছুই জানে না। সত্যি কি তাই? পৃথিবীতে মোট যত মানুষ আছে সেই সংখ্যাটা দিয়ে সমস্ত মানুষের মিলিত স্তন এবং অণ্ডকোষের সংখ্যাকে ভাগ করে কিন্তু তাই আসছে – মাথা পিছু একটি স্তন এবং একটি অণ্ডকোষ। (যদি নারী পুরুষের সংখ্যা সমান সমান হয়।)
তার মানে গড়পড়তা মানুষ সম্পর্কে ক্রেনিয়াসবাসীর রিপোর্টটা একশোয় একশো ভাগ সত্যি। অঙ্কের হিসাবে কণামাত্র ভুল নেই। অথচ, আমরা মর্ত্যবাসী মানুষরা জানি, মানুষ সম্পর্কে এত ভুল বর্ণনা আর হয় না। প্রকৃতির খেয়ালে যদি বা এক অণ্ডকোষবিশিষ্ট পুরুষ বা এক স্তনবিশিষ্ট নারী কখনও হয়ও বা, একই অঙ্গে একটি স্তন এবং একটি অণ্ডকোষ অশ্রুতপূর্ব। অঙ্কটা ঠিক, কিন্তু বাস্তবে আবার এর চেয়ে বড় ভুল কিছু হতে পারে না। প্রথম জনের রিপোর্ট পড়ার পর দ্বিতীয় কোনও ক্রেনিয়াসবাসী এসে পৃথিবী থেকে যদি একটি মাত্র আদর্শ গড়পড়তা নমুনা নিয়ে যেতে চান, তবে সেই একটি স্তন এবং একটি অণ্ডকোষ আছে এমন মানুষ আটশো কোটির মধ্যে একটাও পাবেন না।
দুই ক্রেনিয়াসবাসী, আমি এবং আপনি আর অন্য পাঠকরা কেউই মিথ্যাবাদী প্রবঞ্চক নয়। তবু আমরা মানুষের ‘ঠিক’ বর্ণনায় পৌঁছতে পারছি না। কেন?
কারণ, শরীরে স্তন বা অণ্ডকোষের গুনতির বিচারে ‘গড়পড়তা’ মানুষ বলে কিছু হয় না। মানুষ হয় পুরুষ, নয় নারী। নারীত্ব বা পুরুষত্ব কারও হয় আছে, নয় নেই। হয় আছে, নয় নেই অবস্থার কোনও গড় হয় না। হাতে চারটি রসগোল্লা আর পাঁচটি বোমা আছে মানে নয়টি কী আছে – এই প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না। কয়েকটা সংখ্যার উল্লেখ করে কিছু বলার মধ্যে বেশ একটা authenticity বা বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যি সত্যি ভাব দেখায় বটে। কিন্তু শেষ বিচারে তার অর্থ কিছু দাঁড়ায় না। ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ। এই মজার ছায়াযুদ্ধের প্রহসন একটা চমৎকার বিনোদন হতে পারে। সন্ধে বেলায় লক্ষ রাখুন কোনও টিভি চ্যানেলে অর্থনীতি বা প্রশাসন সংক্রান্ত কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কি না এবং তাতে রাজনৈতিক দলের কোনও প্রতিনিধি আছেন কি না? অল্প বয়স থেকে সিরিয়াসলি রাজনীতি করা লোকের বদলে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ জাতীয় স্বেচ্ছায় কোনও দলের ব্রিফ বহন করা ‘নেতা’ হলে আরও ভাল। অঙ্কের মানে সম্পূর্ণ না বুঝে গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার করায় এঁদের দক্ষতা দৃশ্যত বেশি। তার কারণ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা এখনও করে ওঠেননি কেউ। তবে একটা যুক্তিসঙ্গত অনুমান হতে পারে যে, সিরিয়াসলি রাজনীতি করা লোকেদের অন্তত কোথাও না কোথাও কারও না কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয়। সেই কারণে অন্তত কয়েকটা জিনিস তাঁদের ঠিকঠাক জানতে হয়। ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’-দের সেই দায় নেই। টিভি স্টুডিও-র বাইরে তাঁদের কোনও রাজনৈতিক অস্তিত্ব সচরাচর থাকে না।
শত শত টিভি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের সুবাদে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে অঙ্কের অপব্যবহারের অজস্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। যে গড়ের উদাহরণটা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেটা বাস্তবে ঘটেছিল। দক্ষিণ বঙ্গে গড় বৃষ্টিপাত কত হবে তার পূর্বাভাস যথেষ্ট নিখুঁতভাবে এখন দেওয়া যায়। সেটা জেনে এক কৃষিজীবী বলেছিলেন, তাতে তাঁর কিছুই আসে যায় না। হুগলি জেলা্র খানাকুলে জুলাই মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে কতটা বৃষ্টি হবে সেটা – এবং একমাত্র সেটাই জানা তাঁর দরকার। মজা করে বলে হয়, “Statistics can be made to prove anything – even the truth”। আর একজন রাশিবিজ্ঞানী নাকি এমন একটা সুইমিং পুলে ডুবে মারা গিয়েছিলেন যেখানে জলের গড় গভীরতা তিন সেন্টিমিটার। সত্যি সত্যিই কিন্তু আমাদের রাজ্যে এমন একটা নদীতে জলে ডুবে এক কিশোরের মৃত্যু হল সম্প্রতি, যেখানে গড়ে হাঁটু জল থাকে। কয়েকশো মিটার ধরে পায়ের গোছ ডোবা জলের পর একটা গভীর পাতকুয়োর মতো জায়গা থাকলে গড়টা হাঁটু জলই হবে। এখানে প্রাণ বাঁচানোর জন্য গড়ের হিসাবটা জরুরি নয়, জলের সবচেয়ে বেশি গভীরতা জানাটা দরকার।
অঙ্ক এবং পরিসংখ্যান নিয়ে সবচেয়ে ব্যভিচার চলে, অনধিকারীরা যখন অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে বসেন। অবলীলায় তাঁরা বলতে থাকেন, ১৯৭৭ সালে রাজ্য সরকারের দেনা ছিল ১০০ টাকা, ২০১১-তে এসে ১৬০০ টাকা, আর ২০১৫-তে ২০০০ টাকা (অঙ্কগুলো কাল্পনিক, মূল বিষয়টা বলার জন্য শুধু এগুলোর অবতারণা)। এর থেকে বামপন্থীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, ৩৪ বছরে তাঁরা ঋণের বোঝা ১৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়েছেন, আর তৃণমূল ৪ বছরে ৪০০ কোটি (মানে ৩৪ বছরে গিয়ে দাঁড়াবে ৩৪০০ কোটি)। অর্থাৎ তৃণমূল বামদের দ্বিগুণেরও বেশি অমিতব্যয়ী। একই অঙ্ক থেকে তৃণমূলপন্থীরা বলেন, বামেরা ৩৪ বছরে ঋণের বোঝা ১৬ গুণ বাড়িয়েছে, আর তাঁরা ৪ বছরে মাত্র ১.২৫ (১ দশমিক ৫) গুণ বাড়িয়েছেন (মানে ৩৪ বছরে গিয়ে দাঁড়াবে ৩৪ ভাগ ৪ গুণ ১.২৫ = ১০.৬২৫ গুণ)। সুতরাং বামেরা তৃণমূলের প্রায় দেড়গুণ অমিতব্যয়ী। একই পরিসংখ্যান থেকে ‘প্রমাণ’ করা যায়, তৃণমূল ভাল না বাম ভাল!
টিভি-র আলোচনায় সবাই সমান। ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ এমন অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে একাসনে বসেন নিজ বিষয়ে যিনি বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত। প্রথম জন কেঁদে কঁকিয়ে মাধ্যমিকে অঙ্কে ৩০ পাওয়া, তার পর হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। মহম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর যেমন বলা হয় প্রজারা রাজার থেকে এবং রাজা প্রজাদের থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন, তেমনই তাঁরা অন্য বিষয় ধরার পর তাঁরা গণিতের থেকে এবং গণিত তাঁদের থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিল। দ্বিতীয় জন অঙ্কে জীবনে একশোয় একশো-র নীচে পাননি, অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পণ্ডিতদের সঙ্গে তাঁদের হয়তো যৌথ পেপার (খবরের কাগজের আর্টিকল নয়, গবেষণাপত্র) রয়েছে। বলাই বাহুল্য, প্রথম জনের ‘বিশ্লেষণ’ শুনে দ্বিতীয় জন হাসবেন কি কাঁদবেন বুঝতে পারেন না। প্রায়শই বুঝতে না পেরে আলগোছে নিজের কথাটা বলে যান। প্রথম জনের কথার সত্যি মিথ্যা বিচারে যান না। যান না দুটো কারণে। প্রথমত নিছক ভদ্রতাবশত। আর দ্বিতীয়ত আইনস্টাইনের একটি বাণী স্মরণ করে, “Every problem must be made as simple as possible. But NO simpler”। সব কিছুকে সরল করতে করতে টিভি চ্যানেলের আলোচকেরা এত সরল করে ফেলেন যে তাতে সারবস্তু কিছুই বেঁচে থাকে না। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ভারতে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ভেঙ্কটরমন রামকৃষ্ণনের একটি উক্তি স্মর্তব্য, ‘হোমিওপ্যাথি ওষুধ আর্সেনিকের যে মাত্রা চিকিৎসায় ব্যবহার হয় তাতে কলের জলের চেয়েও কম আর্সেনিক থাকে। ওটায় রোগ সারলে কলের জলেও সারত।
ঋণ প্রসঙ্গে নানা আলোচনার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, টাকার সংখ্যা উল্লেখ করলে যে ইনডেক্সিং (প্রকৃত মূল্যের বিচার) বাধ্যতামূলক তা অনেকের বিবেচনায় নেই। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এক লক্ষ ১২ হাজার টাকার মতো মূল্যের এবং তা দিয়ে শান্তিনিকেতনের পয়ঃপ্রণালীর কাজ করিয়েছিলেন। আজ বিশ্বভারতীর অনেক অধ্যাপক মাসে ওই পরিমাণ টাকা বেতন হিসাবে পান এবং তা দিয়ে বড় জোর নিজের বাড়ির দুটো বাথরুমের কাজ করাতে পারবেন। এ ছাড়াও তো দুটো ভিন্ন সময়ে দুটো সরকারের (এক দলের হোক বা ভিন্ন দলের) ঋণগ্রস্ততা মাপতে গেলে হাজারো বিষয় এসে পড়ে: (১) ঋণ আয়ের কত অংশ? (২) ঋণের সুদ বাবদ খরচ চলতি হিসেবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট – পরিবারের মাসখরচার হিসেবের মতো) কত অংশ? (৩) একই অবস্থায় অন্যরা (এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্য) কী করছে? (৪) আগামী দিনে ঋণ শোধের রোডম্যাপটা কী (কত রাজস্ব আদায় হবে, কত সম্পদ তৈরি হবে ইত্যাদি)
এর পরে আছে দুটো বিষয় যার সঙ্গে শুধু অঙ্ক কষা নয়, ঋণ বিষয়ক দার্শনিক ভাবনা জড়িত।
- অ-ঋণী, অপ্রবাসী কিন্তু শাকান্ন খেয়ে থাকা বনাম ঋণ করে ঘি খাওয়া – কোনটা করব? ভারতীয় দর্শনে দুটোর সমর্থনেই অজস্র যুক্তি।
- সব ঋণ কি শোধ করতেই হবে? আমরা ক’জন মাতৃঋণ, পিতৃঋণ, শিক্ষাঋণ, অন্নঋণ শোধ করতে পেরেছি? প্রাক্তন উপনিবেশগুলির কাছে তাদের ঋণ কটা ইউরোপীয় দেশ শোধ করেছে?
Comments (2)
-
-
দীপঙ্করদা, আপনার আর আপনার মতো কিছু লোকের সমস্যা হল আপনারা কোনও কথা বলার আগে ভাবনা চিন্তা করার দরকার মনে করেন! এই খারাপ রোগটা আপনার মতো আরও কারও কারও মধ্যেও আমি দেখেছি। এই রোগের মূল জীবাণুটা মারাত্মক – তার নাম ‘সংশয়’! আপনারা – অধিকাংশের কাছেই দুর্বোধ্য কোনও কারণে – সব কিছুতে প্রশ্ন করেন! আমরা মিডিয়াতে ফটাফট প্রশ্ন করব, স্যাটাস্যাট আপনারা উত্তর দেবেন – এটাই হল নিয়ম! সেখানে অত সংশয়ের কোনও জায়গা থাকে না। ইন ফ্যাক্ট, সংশয় থাকাটা হল এক ধরনের দুর্বলতা! সবল পুরুষ এবং সবলা নারীর সংশয় থাকতে নেই! আপনি ভাবছেন, আমি আহাম্মকের মতো কথা বলছি? তাকিয়ে দেখুন দুনিয়া এই টাইপেরই সং সয়! সং না হলে সয় না!
-
চমৎকার লেখা। যে প্রশ্নগুলো তুলে ধরেছ তা নিয়ে বিশেষ কারো ভাবনা চিন্তা করার সময় নেই। আরও নানা প্রশ্ন মাথায় উঠে আসে। ভারতের মাথা পিছু বৃদ্ধির হার নাকি এখন সারা দুনিয়াতে চমক জাগাচ্ছে। এদিকে বিডন স্ট্রিটের ফুটপাত নিবাসী একটি ক্লাস সেভেনের মেয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এ ব্যাপারে টিভি চ্যানেলে অর্থনীতির অধ্যাপকের কথা বলা বারণ। কদিন আগেই এই অভিজ্ঞতা হোল। অ্যাঙ্কর বললেন আজ একটা জরুরি রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে গেছে, তাই আপনাকে আর সময় দিতে পারছি না। তারপর শুরু হোল গলা ফাটিয়ে চীৎকার। তখন বসে বসে হাসা ছাড়া কিছু করার থাকে না। যে বিপুল রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছিল বলে শুনলাম তা হোল সিঙ্গুর থেকে পদযাত্রা শুরু করার আগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন আমরা শিল্পের পথেই চলব। তাঁর বলার ভঙ্গিতে কোনো বিনয় ছিল না। এটাই রাজনৈতিক দুর্ঘটনা। অর্থনৈতিক বিকাশের বিনয় বা দম্ভ ভিত্তিক তত্ত্ব আছে কিনা আমার জানা নেই। রাজনীতিবিদরাও, বাম অবাম নির্বিশেষে, উন্নয়ন সম্পর্কে কী ভাবেন তাও জানি না। কোন দল জিতল তার সঙ্গে অর্থনৈতিক বিকাশের কী যোগাযোগ কেই বা জানে! কোন পার্টি দেশ চালাচ্ছে তাই দিয়ে কি আমেরিকার অর্থনৈতিক ভাগ্য নির্ধারিত হয়? এই প্রসঙ্গে উপনিবেশদের ঋণ শোধ করার অপ্রয়োজনীয়তার কথাটার ব্যবহার ভাল লাগল। তবে রাজকোষ ঘাটতি কমাতেই হবে। নইলে ধনী দেশরা গরিবদের ধার দেবে না। এদিকে পুরো শিল্প বিপ্লবটাই যে গরিবদের কাছে ধার নিয়ে ঘটে গেল সে কথা কেই বা মনে রাখে?