সংবাদ ধর্ম, ধর্ম সংবাদ
একটা সমাজ তখনই আধুনিক হয়ে ওঠে যখন ধর্মের বদলে সংবাদ (News) সেই সমাজের মানুষের বুনিয়াদি চালিকাশক্তি এবং কর্তৃত্বের আসন হয়ে ওঠে। দার্শনিকরা কীভাবে সময়ের দিগন্ত পেরিয়ে দূরবর্তী সত্য দেখতে পান, তার একটি চমৎকার উদাহরণ হেগেলের এই কথাটা। তিনশো বছর আগেই এই জার্মান দার্শনিক বুঝতে পেরেছিলেন যে সংবাদ একদিন বিবর্তিত হতে হতে অন্যতম শক্তিশালী ধর্মের জায়গা নেবে।
সত্যিই তো আজ সংবাদ আধুনিক বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ধর্ম। সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী ধর্মও বটে। লক্ষ করলে দেখা যাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইহুদি, খ্রিষ্টীয়, ইসলাম, শিখ ইত্যাদি ক্লাসিক্যাল ধর্মের সঙ্গে সংবাদ নামক ধর্মের একটা খুব বড় মৌলিক পার্থক্য আছে। ওই ক্লাসিক্যাল ধর্মগুলোর মধ্যে একটা ‘হয় এটা নয় ওটা’ ব্যাপার (exclusivity) আছে। আমাদের দেশে সঙ্ঘ পরিবারের মতো যাঁরা মনে করেন মুসলমান হয়েও হিন্দু হওয়া যায়, তাঁরা নিতান্তই সংখ্যালঘু। সারা পৃথিবীর অতি বৃহৎ সংখ্যক মানুষ মনে করেন, একটা ধর্মকে গ্রহণ করতে হলে অন্য সব ধর্মকে পরিত্যাগ করতে হয়। সংবাদ-এর ক্ষেত্রে কিন্তু সে কথা খাটে না। অন্য ধর্মের প্রতি অনুগত থেকেও সংবাদকে মানুষ নিজের জীবনের বুনিয়াদি চালিকাশক্তি এবং কর্তৃত্বের আসন (ইংরেজি অনুবাদে হেগেলের কথাটা হল central source of guidance and touchstone of authority) হিসাবে গ্রহণ করতে পারে।
ক্লাসিক্যাল ধর্মাচরণের কতগুলো সনাতন লক্ষণ বা অভ্যাস সংবাদ ধর্মের ক্ষেত্রে দিব্যি দেখা যায়। যেমন,
- প্রাতঃকর্তব্য = ব্রেকফাস্ট নিউজ (প্রধানত গতকালের নিউজের পাচনের ফল)।
- দুপুরে দেবতার ভোগ = লাঞ্চ আওয়ার (খবরের আগে পিছে একটু রান্না, একটু সিরিয়ালের গপ্পো আর ত্বকের পরিচর্যা যোগ ঐচ্ছিক, ভোগ রান্নায় ভালবেসে একটু মশলার হেরফের করার স্বাধীনতা যেমন ভক্তের থাকে)।
- সন্ধ্যারতি = ইভনিং নিউজ (এটা ‘সিরিয়াস’ ব্যাপার, কারণ এখান থেকে রোজগেরে ‘বেটাছেলেদের’ অক্ষিগোলকও চ্যানেলের কব্জায় আসছে)।
- সন্ধিপূজা = প্রাইম টাইম টক শো (এর উপরে কথা হবে না, সবচেয়ে বড় পুরুত ঠাকুর এখন স্টেজে)।
- অঞ্জলি = এস এম এস-এ বা ফোনে দর্শকের মতামত জ্ঞাপন (এখানে ঠাকুরমশায়রা দেবীর সঙ্গে ভক্তের ডায়রেক্ট যোগাযোগ ঘটিয়ে দিলেন)।
- গোপালের শুতে যাওয়া = মধ্যরাতে নিউজের প্রস্থান, টেলিমার্কেটিং-এর প্রবেশ (ভক্তরা পুজো সেরে বিদায় নিয়েছেন, সেবাইত এবার প্রণামীর বাক্সটা খুলে রেজকি গোনা শুরু করলেন)।
পৌত্তলিক ধর্মের উপমেয়গুলো কারও কাছে আপত্তিকর বা দুর্বোধ্য মনে হলে তিনি অনায়াসে পাঁচ ওয়ক্ত নামাজ পড়া বা পাঁচ পবিত্র ‘ক’ ধারণ করার মতো বিকল্প খুঁজে বার করতে পারেন।
বেশ কয়েক বছর আগে বালক ব্রহ্মচারী নামক এক ধর্মগুরু কলকাতায় বিচরণ করতেন। তাঁর প্রভাব ছিল প্রবল। মৃত্যুর পরও তিনি ফিরে আসবেন, তাই তাঁর দেহ যেন সৎকার না করা হয় – এই ছিল তাঁর নির্দেশ। তাঁর গলিতপ্রায় কীটদষ্ট মৃতদেহ রাজ্য সরকার জোর করে দাহ করেছিল। কিন্তু সে কাজটা করার জন্য একটি স্থানীয় স্তরের নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল সরকার, যাতে ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হয়। এহেন প্রায় সর্বশক্তিমান ব্রহ্মচারীর সঙ্গে একবার পেশাদারি কারণে দেখা করতে গিয়েছিলেন আমার প্রাক্তন সহকর্মী প্রায় বছর পঞ্চাশের এক বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার। দু’জনের কেউই অপরকে তার আগে চিনতেন না। ফোটোগ্রাফার মশাই কলকাতার অন্যতম প্রধান মিডিয়া হাউসের প্রতিনিধি জানার পর দু’জনের কথোপকথন:
বালক (ভক্ত পরিবৃত): আয় এখানে বোস
ফোটোগ্রাফার (একলা): ঠিক আছে
বালক: আয় না, আয়, কাছে আয়, এদিকে আয়
ফোটোগ্রাফার: না, ঠিক আছে, তুই কাজ করে নে, আমি কয়েকটা ছবি নেব
বালক (প্রবল বিস্ময়ে): কী-ঈ-ঈ?
ফোটোগ্রাফার: বললাম তো, আমি অপেক্ষা করছি, তুই কাজ সেরে নে
(ইতিমধ্যে ভক্তরা ফোটোগ্রাফারকে প্রায় মারতে উদ্যত। বাবা তো তুই তোকারি করবেনই। ভক্তরা সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করে বাবাকে আপনি সম্বোধন করবেন, এটাই দস্তুর।)
বালক (হুঙ্কার দিয়ে ভক্তদের নিরস্ত করে): (ভক্তদের প্রতি) যা তোরা বাইরে যা… (ফোটোগ্রাফারের প্রতি) নে ছবি যা চাস…
ফোটোগ্রাফার (ভক্তদের শুনিয়ে একটু অনাবশ্যক উচ্চ স্বরে): একটু এগিয়ে বোস আর মাথার পিছনের লাইটটা নিভিয়ে দিতে বল
বালক ব্রহ্মচারী এবং ওই ফোটোগ্রাফার এই মোলাকাতের আগে কোনও দিন পরস্পরকে দেখেননি। ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মধ্যবয়স্ক মানুষকে যদি কেউ ‘তুই’ সম্বোধন করে তবে প্রত্যুত্তরে তাঁকেও একই সম্বোধন করাই বিধেয়। সব পেশারই এক একটা নিজস্ব ‘ধর্ম’ আছে। ধর্ম মানে চলন বলন। ধর্ম অর্থে property (as in general properties of matter), not religion। আমার সন্দেহ আছে প্রোমোটারি, মন্ত্রিত্ব, চিট ফান্ডের কারবার, দারোগাবৃত্তি বা যৌনকর্মের মতো অন্য যে কোনও র্যান্ডম পেশার মানুষ বালক ব্রহ্মচারীকে ওই রকম অনায়াসে তুই বলার সাহস পেতেন কি না! তার চেয়েও বড় কথা, তুই-এর জবাবে তুই বলার ইচ্ছা তাঁদের হতো কি না!
সংবাদ নামক ধর্মের প্রবল ক্ষমতার সামান্য আভাস মাত্র এখানে দেওয়া গেল। প্রশ্ন:
(১) সেই ক্ষমতা মানুষের মঙ্গল কল্যাণে কতটা ব্যবহার হচ্ছে?
(২) টিভি-র খবরই কি সব? সংবাদপত্রও কি কিছু নয়?
আপনাদের মতামত জেনে পরে বড় করে আলোচনার অবকাশ খোলা রইল। আপাতত দুটো পণ্ডিতবাক্য উদ্ধৃত করা যাক:
(১) পিছিয়ে পড়া হতাশ দেশে টিভি বিজ্ঞাপন বিপ্লবের বার্তা হিসাবে কাজ করে।
(২) সংবাদপত্রের ব্যাধি থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পেতে চান? তা হলে এক বছর ধরে গত সপ্তাহের খবরের কাগজ পড়ুন।
উদ্গাতাদের নামও দেওয়া রইল:
(১) উম্বার্তো একো
(২) নাসিম নিকোলাস তালেব
(Click here to download the post in PDF)
Comments (23)
-
-
Ei lekha sangbadik hisebe amader atmobiswas ke aro sudriho karuk…
-
“A democratic civilization will save itself only if it makes the language of the image into a stimulus for critical reflection — not an invitation for hypnosis.”
― Umberto Eco
পিছিয়ে পড়া হতাশ দেশে টিভি বিজ্ঞাপন বিপ্লবের বার্তা হিসাবে কাজ করে? তা করে হয়তো। হয়তো ঐ বিজ্ঞাপনে ঘুম কাটে। হয়তো বিজ্ঞাপন নিজের ঘুমপাড়ানিয়া ক্ষমতার এতো বড় বিজ্ঞাপন যে লোকে বোঝে সে ঘুমোচ্ছিল।
ডিজাইনার বিপ্লব চাইলে অবশ্য দুই একো একে অপরে ইকো। -
চমত্কার। তবে বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হল লেখাটা। ক্লাসিক্যাল ধর্মাচরণ আর বালক ব্রহ্মচারী প্রসঙ্গে হালকা চালে গুরুগম্ভীর কথা বলেছেন সুদীপ্ত। উপভোগ্য হয়েছে।
শেষ করে অতৃপ্তি রইল। ছোটগল্পের মতো। তবে সেটা ছোটগল্পের শেষের মতো একেবারে শেষ নয়— এটাই ভরসা। সেটা বোঝার জন্য লেখার শেষে সাংবাদিকের চিন্তা-উসকে দেওয়া উদ্ধৃতি এবং ইঙ্গিতটুকুই যথেষ্ট। ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা নিয়ে এই ধরনের আরও লেখা পড়ার অপেক্ষা তৈরি হল। -
I could not resist myself from sharing ! Please do not mind.
-
Sudipta, onobodyo lekha hoyechhe. Tobe duto proshno aachhe
1. Songbad dhormer jayga niye Somaj chalabe byaparta bhoyonkor karon songbad madhyom jara chalay tarao munafa lobhi. Se khetre tumi ki mone koro NGO der egiye Asa uchit songbad madhyom chalanoye ?
2. Bignapon ki shudhui hotash deshei hoy ?
-
Khub bhalo lekha, Kintu bisoibastur bistar r ektu hole bhalo hato.
-
Aapnar lekhata pore bhishon bhalo laglo. aamar ekta moner katha jeta aapni bolechhen “tui to kaari” prasange seta nie bhabtaam je keno police ra madhyabayaska ba bayose chhotoder tui bole sambodhan kore? ebong eta nie kotha o aalochona hoyna? aamar oi sanbadik er motoi ichha kore je aami onader sakhanor janney tui bole daki. kothay ei prosongo aalochito hote dekhe khoob bhalo laglo.
-
Darun bolechen anek din par jeno satya ke pelam.
-
Darun laglo.akebare satya.
-
আমার মতে ভাল লেখা সেইগুলি যা আপনাকে ভাবায়। আমার প্রশ্ন বালক ব্রহ্মচারী বা তাঁহার অনুগামীরা কি টের পাইয়াছিলেন যে তাঁহার প্রচারিত ধর্মের সমতুল ধর্ম কলমের খোঁচায় প্রচারিত হয়? ‘ধর্মীয়’ অসহিষ্ণুতার প্রভাব এখানে কতটা? তবে হ্যাঁ সনাতনি ধর্মকে বর্ম করে যে সকল সাধু রা তাদের কামনা বাসনা চরিতার্থ করছেন তাদের স্বরূপ উন্মোচনে নয়া ধর্মের শতফুল বিকশিত হওয়া দরকার।
-
আমার মনে হয়, পুরো ব্যাপারটা এখন convenienceএর পর্যায় চলে গেছে. চোখ বন্ধ করে, আরাম কেদারায় বসে, শুয়ে অথবা আধশোয়া অবস্থায়, আর যাই হোক, খবরের কাগজ পরা যায় না. খবরের কাগজ পড়তে একটু জোগার লাগে – চশমা (সবার নয়), আলো, টেবিল-চেয়ার অথবা পর্যাপ্ত জায়গা (যেখানে একটু খেলিয়ে বসা যায়) ইত্যাদি. TV দেখতে সেরকম কিছুর প্রয়োজন হয় না. TVর খবরই হয়তো সব নয়, তবু convenienceএর জন্যই বোধহয় বেশি popular.
-
ধ্রুপদী ধর্মাচরণের সঙ্গে চ্যানেলের সংবাদ সারাদিনের তুলনা বেশ উপভোগ্য। সংবাদ ধর্মের প্রভাব কীরকম সেটি সাংবাদিকতার প্রথম যুগেই উইলিয়াম হার্স্ট, নেলি ব্লাইয়েরা দেখিয়ে গিয়েছেন। যখন সাংবাদিকতা ছিল না তখনও মৌখিক সংবাদ ধর্মের বেশ প্রভাব ছিল। এখনও তার প্রমাণ মেলে। গোমাংস ভক্ষণের গুজবে ইকলাখকে পিটিয়ে খুনের ঘটনা তারই প্রমাণ। প্রশ্নটা এখানেই, কোন সংবাদ ধর্ম শক্তিশালী? যা দেখানো বা পড়ানো হয়? নাকি তার আড়ালে থেকে যাওয়া সত্যি (কোনও কোনও ক্ষেত্রে। যেখানে স্বার্থ বা সম্পর্ক কাজ করে কারও কারও)? মানে ইচ্ছাকৃত ধুয়ো তোলার কথা বলতে চাইছি। লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সেই ক্ষমতা মানুষের মঙ্গল কল্যাণে কতটা ব্যবহার হচ্ছে?’ আবহাওয়া দফতরের খবর, আজ বৃষ্টি পারে’ এই ব্রেকিং নিউজ দেখতে বাধ্য হওয়া আমার মতো অনেকেরই সেটাই প্রশ্ন।
Ami borabori Sudipta Da r lekhar vakto. Ei lekha ta anobadya…. onyo rakom bhabte shekhay.