এই বেদনা ক্ষমা করো / ১
আর কয়েক দিন পরেই সে দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইবেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ক্ষমা চাইবেন সে দেশের শিখ সম্প্রদায়ের কাছে। ক্ষমা চাইবেন একশো দু’বছর আগে হয়ে যাওয়া এক ‘ভুলের’ জন্য।
কী হয়েছিল আজি হতে শতবর্ষ আগে?
১৯১৪ সালের ২৩ মে। কোমাগাতা মারু নামে একটি জাপানি জাহাজ ৩৭৬ জন ভারতীয় (যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই শিখ সম্প্রদায়ের) নিয়ে কানাডার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু ভ্যাঙ্কুভারে সেই জাহাজ পৌঁছনোর পরে যাত্রীদের জাহাজ থেকে নামতে দেওয়া হয়নি। তৎকালীন কানাডা সরকার দাবি করে, সে দেশে নামার জন্য প্রত্যেক এশীয় যাত্রীকে দু’শো ডলার দিতে হবে। অত টাকা কোমাগাতা মারুর কোনও যাত্রীরই সঙ্গে ছিল না। তাই তাঁদের কানাডায় নামতে দেওয়া হয়নি। যাত্রীরা অবশ্য দাবি করেছিলেন, কানাডা এবং ভারত, দু’টি দেশই ব্রিটিশ উপনিবেশ। ফলে এই বৈষম্যমূলক আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। দীর্ঘ দু’মাসের টালবাহানার পরে জিত হয় কানাডীয় প্রশাসনের। ভারতে ফেরত পাঠানো হয় কোমাগাতাকে।
জাহাজের যাত্রীদের হেনস্থা এখানেই শেষ নয়। চার মাস পরে, ২৭ সেপ্টেম্বর কলকাতার বজবজে এসে ভেড়ে জাহাজটি। ব্রিটিশ সরকার জাহাজের যাত্রীদের ‘আইনভঙ্গকারী’ তকমা দিয়ে গ্রেফতার করতে উদ্যোগী হয়। বাধা দেন যাত্রীরা। ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে ১৯ জন যাত্রী নিহত হন। গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয় বেশির ভাগ যাত্রীকে। আর পালিয়ে যান অল্প কয়েক জন।
কানাডার অভিবাসনের ইতিহাসে কোমাগাতা মারু এক কলঙ্কিত অধ্যায়। অভিবাসীরা এখন এই দেশের একটা বড় অংশ। এবং দেশের বিশাল সংখ্যক ভারতীয় অভিবাসীকে পাশে পেতে রাজনৈতিক নেতারা তাই একাধিক বার পূর্বসূরিদের হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। ২০০৭ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার প্রাদেশিক সরকার শিখ সম্প্রদায়ের কাছে সরকারি ভাবে ক্ষমা চায়। তার পর ২০০৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারে শহরে একটি সমাবেশে কোমাগাতা মারু-র প্রসঙ্গ তুলে কানাডার শিখদের কাছে আবার ক্ষমা চান। কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। শিখরা দাবি করেন, এ রকম ‘বেসরকারি’ ক্ষমাপ্রার্থনার কোনও মূল্য নেই। ক্ষমা চাইতে হবে খাস পার্লামেন্টে।
গত বছর ক্ষমতায় এসেছেন লিবারাল দলের নেতা, ৪৪ বছর বয়সি জাস্টিন ট্রুডো। তাঁর ক্যাবিনেটে ৩০ জন সদস্যের মধ্যে ১৫ জন মহিলা, কোমর থেকে পঙ্গু এক চলৎশক্তিহীন ব্যক্তিও। মন্ত্রী হয়েছেন তিন শিখ-সহ চার ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এই ‘বিচিত্র’ ক্যাবিনেট নিয়ে তখন সংবাদমাধ্যমে প্রচুর চর্চা হয়েছিল। বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত, ৪৫ বছর বয়সি হরজিত সজ্জনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে বসানোয় দেশ জুড়ে আলোড়ন পড়ে যায়।
পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেশ ছেড়েছিলেন হরজিত সজ্জন। কানাডাতেই বড় হয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন সেখানে। তার পর যোগ দিয়েছেন সে দেশেরই সেনাবাহিনীতে। দীর্ঘদিন ছিলেন আফগানিস্তান, বসনিয়া ও হেরজেগোভিনায়। ফিরে এসে কানাডা পুলিশে যোগ দেন।
এ রকম এক ‘যোগ্য’ ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা নিয়ে বিতর্ক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যতই তিনি মন্ত্রী হোন না কেন, বর্ণবিদ্বেষের ভূত পিছু ছাড়েনি হরজিতের।
এ বছর ১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। মন্ত্রী হওয়ার পরে সবে দু’মাস কেটেছে। পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিচ্ছেন সজ্জন। কনজারভেটিভ দলের বর্ষীয়ান সাংসদ জেসন কেনি বলে ওঠেন, ‘‘মিস্টার সজ্জনের কথা বুঝতে গেলে ইংরেজি থেকে ইংরেজি অনুবাদ করা প্রয়োজন!’’ সজ্জনের দলীয় সতীর্থরা হইহই করে ওঠেন, দাবি তোলেন, এ রকম বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্য করার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে কেনিকে। সে পথে আদপেই হাঁটেননি কনজারভেটিভ সাংসদ। বরং তার পরে টুইটারে সাফাইও দেন— ‘‘সত্যিই সজ্জনের কোনও কথাই বোঝা যাচ্ছিল না। যতই ইংরেজিতে বলুক, ওর কথার কোনও মাথামুন্ডু ছিল না।’’
এক জন মন্ত্রীকে এ রকম বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্যের মুখে পড়তে হলেও পার্লামেন্ট কিন্তু সাংসদ কেনির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকী, সংবাদমাধ্যমেও বিষয়টা নিয়ে বিশেষ জলঘোলা হয়নি। দু’-একটি কাগজে খবরটা বেরিয়েছিল বটে। কিন্তু ভাবটা কেমন যেন দায়সারা। যেমন ‘দ্য টরন্টো সান’। টরন্টোর এই প্রথম সারির দৈনিকে লেখা হয়েছিল— “Jason Kenney’s request for an English to English translation of Defence Minister Sajjan dubbed racist“। আশা করি, ‘request’ বা ‘dubbed’ শব্দ দু’টির সচেতন প্রয়োগ পাঠকদের চোখ এড়াচ্ছে না! আরেকটি কানাডীয় দৈনিক ‘ন্যাশনাল পোস্ট’-এর হেডিং— ‘‘Liberals call Jason Kenney a racist for requesting English to English translation of Minister Sajjan।’’ শুধু হেডিংই নয়, গোটা লেখাটা জুড়েই জেসন কেনির হয়ে সাফাই দেওয়ার একটা চেষ্টা চোখ এড়ায় না। আর কানাডার সব থেকে বেশি প্রচারিত দৈনিক ‘টরন্টো স্টার’ বা তার সংশ্লিষ্ট খবরের পোর্টাল ‘দ্য স্টার’-এ সজ্জন-হেনস্থার কোনও খবরই প্রকাশিত হয়নি। অন্য দিকে, ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ হয়েছিল, এবং অধিকাংশ ইংরেজি সংবাদমাধ্যমই ‘heckled’ (প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা বা হেনস্থামূলক ভাবে একের পর এক প্রশ্ন করে যাওয়া) শব্দটি ব্যবহার করেছে। সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (PTI) লিখেছিল— “Canada’s Sikh Defence Minister heckled with racist remarks.”
প্রসঙ্গত, যে ভ্যাঙ্কুভারের বন্দরে নামতে দেওযা হয়নি কোমাগাতা মারুকে, সেই ভ্যাঙ্কুভারেরই বাসিন্দা সজ্জন!
তবু কানাডার বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর এই পাঁচমিশেলি ক্যাবিনেটের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। শপথ নেওয়ার সময়ে ট্রুডো বলেছিলেন, ‘‘এটা ২০১৫ সাল। এটাই কানাডা।’’ আর সেই প্রধানমন্ত্রী যে শপথের কয়েক মাস পরেই কোমাগাতা মারুর ঘটনার জন্য ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কাছে ক্ষমা চাইবেন, তা কিছুটা প্রত্যাশিতই।
রাষ্ট্রপ্রধানেরা ক্ষমা চাইলে তা অবশ্য খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বা প্রাইম টাইম নিউজে সহজেই জায়গা করে নেয়। লেখা হয় পত্রিকার বিশেষ কভার স্টোরি। যেমন টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘দশটি ক্ষমা’ (Time Magazine: Top 10 National Apologies) নামের এক প্রবন্ধ। ক্ষমাপ্রার্থনার সেই অনতিদীর্ঘ তালিকাটিতে বেশ কয়েকটি বড়সড় নাম আর কয়েকটি দুনিয়া-কাঁপানো ঘটনা। যেমন, জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট। তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন জার্মানদের ইহুদি নিধনের জন্য। তালিকায় রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথার জন্য। তা ছাড়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন অ্যাপারথাইড যুগের শেষ প্রেসিডেন্ট ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানের যৌন ক্রীতদাসী প্রথার বাড়বাড়ন্তের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। আর একটি চমকপ্রদ ক্ষমাপ্রার্থনা— গালিলেও গালিলির গায়ে অপরাধী তকমা এঁটে দেওয়ার জন্য ভ্যাটিকানের হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন পোপ দ্বিতীয় জন পল।
ক্ষমা চাওয়ায় বিশেষ পটূ ছিলেন এই পোপ দ্বিতীয় জন পল। তার একটা কারণ অবশ্যই উপনিবেশিকতা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথলিকদের দুনিয়াব্যাপী নিগ্রহের ন্যক্কারজনক ইতিহাস। গ্যালিলিওর বিচার ছাড়াও পোপ দ্বিতীয় পল ক্ষমা চেয়েছিলেন আফ্রিকার মানুষদের ক্রীতদাস বানানোয় ক্যাথলিক যাজকদের মদতের জন্য, হোলোকাস্ট পর্বে রোমান ক্যাথলিক চার্চের নীরবতার জন্য, প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনে ক্যাথলিকদের দমনমূলক নীতির জন্য এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশের আদি বাসিন্দাদের ওপর অপরিসীম নির্যাতন চালানোর জন্য।
দেশের আদি বাসিন্দাদের ওপর অকথ্য অত্যাচারের স্মৃতি ভুলতে চাননি এই প্রজন্মের অনেক রাজনীতিবিদই। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড— দেশের আদি বাসিন্দাদের কাছে নতজানু হওয়ার পরম্পরায় রয়েছেন অনেকে রাষ্ট্রনেতাই। পূর্বপুরুষের কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান তাঁরা, সে কথা তোলা থাক দ্বিতীয় কিস্তির জন্য।
লেখাটি পড়লাম। লেখিকা বলতে চেয়েছেন, কোমাগাতা মারু নিয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়ার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে। অনাবাসী ভারতীয়দরে ভোটব্যাঙ্কই আসলে লক্ষ্য। কিন্তু পূর্বসূরিদের কৃতকর্মের জন্য উত্তরসূরিদের ক্ষমা চাওয়া বোধহয় সবসময় উদ্দেশ্যমূলক হয় না। মাওরিল্যান্ডের উদাহরণ টানা যেতে পারে। মানে নিউজিল্যান্ড। সাদা চামড়ার (বর্ণবিদ্বেষী হয়ে গেল বোধহয়) শাসক মাওরিদের হঠিয়ে দেশটি দখল করেছিল। এতদিন পরে মাওরিদের কাছে সেজন্য ক্ষমা চাওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশের সম্পদ থেকে একসময় তাঁদের বঞ্চিত করার জন্য মাওরিদের ক্ষতিপূরণও দেওয়া হচ্ছে।
আর মন্ত্রী সজ্জনের প্রতি কেনির মন্তব্যকে আমার বর্ণবিদ্বেষী বলে মনে হয়নি। আমার মতো স্বল্প শিক্ষিতেরা যখন ইংরেজি চ্যানেলে ইংরেজি ভাষায় সিনেমা দেখি, সাবটাইটেলের দিকে নজর রাখি। যদি সেটা হলিউড বা ইউরোপীয় সিনেমা হয়। কিন্তু জ্যাকি চ্যান বা ব্রুস লির মতো এশীয়দের সিনেমায় কিন্তু সাবটাইটেলের দিকে তাকিয়ে অভিনয় চোখ ছাড়া করার দরকার হয় না। এশীয় এবং ইউরোপ-আমেরিকার ইংরেজি উচ্চারণে তফাৎ যে আছে সেটা কি অস্বীকার করা যায়? সত্যিটা বললে বর্ণবিদ্বেষীই বা হবে কেন?
এ বিষয়ে মুজতবা আলির স্মরণ নেওয়া যেতে পারে। গল্পটা মোটামুটি এরকম, এক জার্মান শিক্ষিত বাংলাদেশি জার্মানি গিয়েছেন। বন্দরের কুলিদের তিনি জার্মানিতে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু কুলি সেসব বুঝতে না পেরে সঙ্গীকে ডেকে বলেন, দেখ তো লোকটা বোধহয় ফরাসি বলছে। এটা কি বর্ণবিদ্বেষের গল্প।