আজাদি চাই, আমারও
সমর্থনের জোয়ার আছড়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দি ছাপিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায়। তার পর রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের অন্য শহরেও— কলকাতা, হায়দরাবাদ…। দ্রুত খবর ছড়াচ্ছে চ্যানেলে চ্যানেলে! আরও দ্রুত জনমত তৈরি হচ্ছে ফেসবুক, টুইটারে। বাড়ছে লাইক, রি-টুইট, শেয়ার।
হবেই তো! কুড়ি দিন জেলে থেকে বেরিয়ে কী কাণ্ডটাই না করেছে ছেলেটা! পুলিশে ছুঁলে যে অগুন্তি ঘা, তা কেউ বুঝবে ওকে দেখে? কানহাইয়া কুমার। মনুবাদে-দুষ্ট এ দেশের উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলা (একটি প্রত্যাশিত মৃত্যু, একটি অপ্রত্যাশিত খবর) তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি জেএনইউয়ের এই ছাত্রনেতা। ১২ ফেব্রুয়ারি ‘দেশদ্রোহ’-এর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন কানহাইয়া। কুড়ি দিন তিহাড়ে কাটিয়ে যখন গত বৃহস্পতিবার বেরোলেন, তখন তাঁর তুখোড় বাগ্মিতায় ভেসে গেল দেশ, ভেসে গেল দেশের সংবাদমাধ্যমও।
কানহাইয়া বুদ্ধিমান। কানহাইয়া সংবেদনশীলও। এখনও তাঁর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শিকড় ছিড়ে ফেলেননি। তাই তিহাড় থেকে বেরিয়ে, জেএনইউয়ে ফিরেই, হায়দরাবাদের সেই আত্মঘাতী দলিত ছাত্রকে ‘আমার আদর্শ’ বলে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের রোহিতকে ভোলেননি বেগুসরাইয়ের কানহাইয়া।
কিন্তু এই প্রতিবেদন কানহাইয়া বা তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে নয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তাঁর মন ছুঁয়ে যাওয়া বক্তৃতার বিশ্লেষণ বা তাঁকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের হামলে পড়া নিয়েও নয়। এমনকী, তাঁকে দেশদ্রোহী বানিয়ে দেওয়ার চক্রান্তে দেশের প্রথম সারির দু’টি খবরের চ্যানেলের অবদান প্রসঙ্গেও নয়। আজকের লেখা এমন এক জন মানুষকে নিয়ে, যিনি গত পনেরো বছর ধরে সেই লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা ব্যাখ্যা করা যায় কানহাইয়ার বক্তৃতা থেকেই একটা বাক্য ধার করে— ‘‘দেশ থেকে মুক্তি নয়, দেশের ভিতরে থেকেই মুক্তি চাই আমরা।’’ অত্যন্ত বেদনার কথা, এই মানুষটিকে কিন্তু সহযোদ্ধা হিসেবে কখনও উল্লেখ করেননি কানহাইয়া। আর কানহাইয়াকে নিয়ে এ কয়েক দিনের কয়েকশো প্রতিবেদনেও তাঁর নাম দেখলাম না কোথাও।
আজকের খবর যখন কালকের ঠোঙা, তখন পনেরো বছর আগের কথা আমার-আপনার মনে থাকবে, এটা ভাবা ঠিক নয়। বিশেষ করে যখন গড়পড়তা খবরের কাগজ বা চ্যানেল এই গল্প বিশেষ বলে না। এই সুযোগে তা হলে ফিরে যাওয়া যাক পনেরো বছর আগের এক দিনে।
২০০০ সালের ১ নভেম্বর। মণিপুরের ছোট্ট শহর মালোমে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন দশ জন স্থানীয় বাসিন্দা। অসম রাইফেলসের বাহিনী এসে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলে সেই দশ জনকে। নিরাপত্তা বাহিনী পরে দাবি করেছিল, জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন এই সব সাধারণ মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি অবশ্য সম্পূর্ণ অন্য ছবি তুলে ধরে।
পরের দিন খবরের কাগজে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহগুলোর ছবি দেখে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিল ২৮ বছরের এক মেয়ে। দেহের স্তূপের মধ্যে থেকে ১৮ বছরের সিনোম চন্দ্রমণির মুখটা চোখ বন্ধ করলেও দেখতে পাচ্ছিল সে। এই সিনোমকেই ছোট্টবেলায় সাহসিকতার পুরস্কার দিয়েছিল ভারত সরকার। সেই সিনোমকে কী করে এ ভাবে মেরে ফেলল পুলিশ, সেই কথাই সমানে মাথায় ঘুরছিল তার।
মালোমের ঘটনা অবশ্য প্রথম নয়। মণিপুরে সেনা-সন্ত্রাস তার আগেও ঢের দেখেছে সে। কিন্তু মালোমের ঘটনা যেন তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিল। ঘটনার দু’দিন পরে, ৪ নভেম্বর বিকেলে মাকে তার পরিকল্পনার কথা জানায় মেয়েটি। যে-আইন ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতে এ ধরনের সন্ত্রাস চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী, সেই ‘আফস্পা’ প্রত্যাহারের দাবিতে অনশনে বসবে সে। যত দিন না সরকার তার দাবি মানছে, অনশন চলবে।
অনশন শুরু করার দু’দিন পরেই তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ‘আত্মহত্যার চেষ্টা’র অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়। বেশ কয়েক দিন ধরে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু টলানো যায়নি। স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় নাক দিয়ে খাদ্য-নল ঢুকিয়ে হাসপাতালেই নজরবন্দি করে রাখা হয় তাকে। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে আত্মহত্যার চেষ্টা দণ্ডনীয় অপরাধ। দোষী ব্যক্তির এক বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। প্রথম বার মেয়েটিকে এক বছর হাসপাতালে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, নাকের ফুটো দিয়ে খাবারের টিউব পরিয়ে। কিন্তু ছেড়ে দেওয়া মাত্রই নল-টল খুলে ফেলে সে। ফলে দিন কয়েকের মধ্যেই পুলিশ ফের গ্রেফতার করে তাকে। হাসপাতালে পুরে নাক দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় খাবারের টিউব।
সেই থেকে গত পনেরো বছর ধরে এ-রকমই চলছে। বছরের প্রায় পুরোটাই হাসপাতালে বন্দিদশা। তখন চলতে থাকে নাকে নল পুরে শরীরে তরল ঢোকানোর প্রক্রিয়া। যে-কয়েক দিন ‘মুক্ত’ থাকে, নল-টল খুলে ফেলে ফিরে যায় অনশনের পুরনো ধাঁচে। ফলে দু’-এক দিনের মধ্যেই ফের গ্রেফতার। আবার হাসপাতাল। অনশন-‘অপরাধ’-এর এই আবর্ত থেকে কিছুতেই আর বেরোতে পারে না মেয়েটি। বেরোতে কি চায়? ‘‘একটা জিনিসই চাই আমি। পরিস্থিতিটা পাল্টাক। আমরা মুক্তি পাই’’— কানহাইয়া আজাদির স্লোগান তোলার বহু বছর আগে মেয়েটি বলেছিল এক সাক্ষাৎকারে।
হাসপাতালে জোর করে নল দিয়ে দেহে তরল ঢোকানোই হোক বা বাড়িতে স্বেচ্ছায় নির্জলা উপবাস, ২০০০ সালের ৪ নভেম্বর থেকে মুখ দিয়ে এক ফোঁটা জল খাওয়ানো যায়নি মেয়েটিকে। আজ পর্যন্ত। কানহাইয়া যখন ‘খিদের জ্বালা থেকে আজাদি’র কথা বলেন, তখন আজাদির জন্য খিদের আগুনে ঝাঁপ দেওযার এই কাহিনি কেন কোনও সাংবাদিকের কলমের ডগায় উঠে আসে না?
খবরের ‘নেওয়া, না-নেওয়ার’ এই রাজনীতি, এই ছাঁকনি দিয়ে খবর বেছে নেওয়ার কাহিনীর পিছনে রয়েছে দেশের কিছু অঞ্চলকে ব্রাত্য করে রাখার গল্পও। তাই কাশ্মীর যত সহজে কাগজের পাতায় জায়গা করে নেয়, তার থেকে অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় দেশের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোকে। সে-রকমই এক ‘প্রত্যন্ত’ রাজ্যের বাসিন্দা তো মেয়েটি। সেখানকার সেনা-নির্যাতনের বিরুদ্ধেই তো তার অনশন-প্রতিবাদ।
২৯ ফেব্রুয়ারি ইম্ফলের এক আদালত ‘নির্দোষ’ বলে মুক্তি দিয়েছিল মেয়েটিকে। কালক্ষেপ না-করে ততক্ষণাৎ আবার অনশন শুরু করে দেয় সে। পুলিশ তাকে ফের গ্রেফতার করে ২ মার্চ। কিছু কাগজে সেই খবর দু’লাইন বেরোলেও এ দেশের অধিকাংশ কাগজের নানা ‘দরকারি’ খবরের ভিড়ে চাপা পড়ে যায় ‘কত বছর ধরে তো একই কাণ্ড করছে’ ছাপ লেগে যাওয়া মেয়েটির খবর।
এখন আর অবশ্য মেয়ে বলা যায় না তাকে। দিন কয়েক বাদেই ৪৪ পেরোবে সে।
পরাধীন এই ভূমে স্বাধীন। ইরোম শর্মিলা চানু।
Comments (5)
-
asadharan lekha seemantindi. asole sharmilar lorai ta kono din e baki bharater lorai haye uthte parlo na keno sei uttor tar madhyei lukiye ache aro anek jotil prashna. kanhaiya ke niye bhese jete jeteo sharmila ke mone koriye deoar janya tomake dhanyabad
-
ধন্যবাদ শর্মিষ্ঠা।
সায়ন্তনী, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা কবিতার কয়েকটা লাইন— রাজা আসে, রাজা যায়। শুধু পোশাকের রং বদলায়। কমেন্টটা পড়ে সেটা আবার মনে পড়ে গেল।
-
-
Chhotobelay mone achhe, itihas boie porechhilam, “Manush gostthibaddha jib. Sei adim kal era doloboddho bhabe thake. Dole ekjon neta thake. Bakira take anusaran kore chole.” R sekhanei poradhinatar shuru. Majhe majhe vidroho shuru hoy bote. Neta bodlay. Azadi kintu asena. Shuru hoy natun netar dasotto.
-
Khubi joruri lekha, Seemantini. Ei blogey tomar arekta lekhao khub bhalo laglo ebong joruri mone holo. Aro lekho.
ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়!