ভোটারদের গোপন কম্ম কিংবা মিডিয়ার হালে পানি...
Graphics: https://www.flickr.com/photos/donkeyhotey/
গাঁয়ের স্কুলে আমাদের মাস্টারমশাইরা বলতেন, বোঝায় ঘাটতি থাকলে ব্যাখ্যার বোঝা বেড়ে যায়। এবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রেক্ষিতে সংবাদমাধ্যমের অবস্থা দেখে মনে পড়ল সেই পুরনো কথাটাই।
মানুষের মন বোঝায় ঘাটতি যে ছিল, সে তো বোঝাই গিয়েছে। নইলে তাবড় সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, ওয়েবম্যাগের দুঁদে সাংবাদিকদের কি আর মাথায় হাত পড়ত!
সকলেই ফেলুবাবু। ভোটারদের ‘গোপন কম্মটি’ কেউ কিচ্ছু টের পাননি আগে থেকে। কীভাবে ট্রাম্পসাহেব নিঃশব্দে একের পর হিলারির শক্ত ঘাঁটির মজবুত খুঁটি উপড়ে নিয়ে চলে গিয়েছেন।
ভোটের আগে তে রোজ সমীক্ষা, আর রোজ রোজ জয়ী হিলারি। এই আজ অ্যাতো এগিয়ে গেলেন হিলারি। এই আজ বোঝা গেল, হিলারির ইমেল তদন্তের ঘোষণায় কিছুই প্রভাব পড়েনি। মহিলারা কোমর বেঁধে ট্রাম্পকে হারিয়ে দিলেন বলে! ইত্যাদি ইত্যাদি।
সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হওয়ার পর নির্মল হাসি ছাড়া খুব কিছু উপহার দেওয়ার নেই সংবাদমাধ্যমের।
তবে সেটা বললে মান থাকে না। তাই ভোটের আগে যতগুলো কারণ দেখানো হয়েছিল হিলারির সম্ভাব্য জয়ের, ফলাফল উল্টে যাওয়ার পর তার চেয়ে গোটা চারেক বেশি কারণ দেখাতে না পারলে সম্মানরক্ষা হয় না। অতএব কারণ খোঁজো। খোঁজা প্র্যাকটিস কর। সেই প্র্যাকটিস বলতে কী, এখনও চলছে। কোনও না কোনও সংস্থা ব্যাখ্যা করেই চলেছে কেন নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হল না।
তাতে যা হয়। কেন হারলেন হিলারি, সেই ব্যাখ্যা দিতে তো বাক্স খুলে কবেকার জামাকাপড়ের মতো টেনে টেনে কারণগুলো বের করতে শুরু করেছেন মিডিয়ার লোকজন। হিলারি নিজে কিছু দিয়েছেন। সমর্থকেরা কিছু দিয়েছেন। ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকদের পক্ষ থেকেও আরও কিছু যোগ করা হয়েছে। এর পরে আবার সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব কিছু পয়েন্টস রয়েছে। অতএব গল্প অল্প নয়।
লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস নাকি এই বিপুল হিলারি-জনপ্রিয়তার মধ্যেও তাদের ট্রাম্পের নৌকা বাইয়ে দিতে পেরেছিল। তারাই একমাত্র এই নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করে সকলের বিস্ময়ভাজন হয়েছেন। এ নিয়ে তাদের অনেক ব্যাখ্যার মধ্যে একটি সাংবাদিকদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক মনে হতে পারে। তা হল, এবারের নির্বচনের আগে হিলারির ব্যাপক জনপ্রিয়তা, সমীক্ষার কাজেও প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কীভাবে? ট্রাম্পবিরোধী হাওয়া তথা হিলারির জনপ্রিয়তায় টেলিফোনে যখন সমীক্ষা চালানো হয়েছে, তখন অনেকেই মুখ ফুটে সত্যি কথাটা বলেননি।
ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার কথা নাকি অনেক মহিলাই সমীক্ষককে জানাতে অস্বীকার করেছিলেন। মহিলাদের প্রতি ট্রাম্পের অসম্মানসূচক মন্তব্য, ট্রাম্পের সঙ্গে ডজনখানেক মহিলার আপত্তিকর সম্পর্ক, হিলারির প্রতি অসাংবিধানিক শব্দপ্রয়োগ— এসব কিছুই এমনভাবে প্রচারের আলোয় এসেছিল যে, মহিলা হয়ে ট্রাম্পের সমর্থক হওয়াটা রীতিমতো লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ট্রাম্পের সমর্থকেরাও বলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন তাঁরা ওঁকে ভোট দেবেন।
অর্থাৎ হিলারির জনপ্রিয়তাই সংবাদমাধ্যমের চোখে কার্যত ঠুলি পরিয়ে রেখেছিল। জয় নামক প্রায় ঘটিতব্য সেই ‘মোহ আবরণ’ ভেদ করে আমেরিকার আপামর ভোটারের মন ছোঁওয়া অতএব সহজ হয়নি সমীক্ষকদের। ফলে ছোট-বড়, বিখ্যাত-অখ্যাত সংবাদমাধ্যমগুলি একধরনের আত্মতুষ্টিতে ভুগে সেই সমীক্ষা উল্টোদিক থেকে যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করেনি।
অন্যভাবে বললে, সংবাদমাধ্যম যা বিশ্বাস করতে চেয়েছে, সেটার প্রচার এতটা নিশ্চিতভাবে করে গিয়েছে যে, সেই স্বখাত সলিলেই ডুবে মরতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। সেই প্রচারের প্রভাব অধিকাংশকেই মূক করে রেখেছিল। ফলে আসল তথ্য ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই চাপেই চাপা পড়ে গিয়েছিল।
একই কথা বলা যায় স্বল্পশিক্ষিত (যারা কলেজের চৌকাঠ মাড়াননি) শ্বেতাঙ্গদের সম্পর্কে। যাঁরা এই ভোটে হিলারির সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবধান গড়ে দিয়েছেন। এঁরাও নাকি সমীক্ষায় তাঁদের আসল মনোভাবের কথা জানাননি। যেখানেই দেখা গিয়েছে এই শ্রেণির ভোটারের সংখ্যা তুলনায় বেশি, সেখানেই হিলারি-ট্রাম্প ব্যাবধানও বেশি।
প্রশ্ন হল লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের সমীক্ষা ফলাফলের কাছাকাছি গেল কী করে? লস এঞ্জেলেস টাইমস মনে করে, তাদের ইলেক্টনিক সমীক্ষার দরুণ ভোটার সমীক্ষকের প্রশ্নের মুখোমুখি হননি। ফলে নির্দ্বিধায় জানাতে পেরেছেন কাকে ভোট দিয়েছেন তাঁরা। অধিকাংশ সমীক্ষাই টেলিফোনে হয়েছে। অন্য অনেক প্রশ্নের সঙ্গে ভোটারদের কাছে কাকে এবং কেন ভোট দিয়েছেন তা সরাসরি জানতে চেয়েছেন সমীক্ষা সংস্থার প্রতিনিধিরা। সেই প্রশ্নেই সংকোচ কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি অধিকাংশ ভোটার। ফলে ট্রাম্পের জয় আগাম সমীক্ষা বা বুথফেরত সমীক্ষায় প্রতিফলিত হয়নি।
তাহলে বোঝা গেল, গণতন্ত্র সফল করতেই শুধু প্রভাবহীন, শঙ্কাহীন,পরিবেশের প্রয়োজন হয়না। সমীক্ষা সফল করতে হলেও সেটা প্রয়োজন।
আর্লি ভোটিংয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত, কোন দলের সমর্থক তা পঞ্জীকরণের সময় বোঝা যায়। এবারেও তার অন্যথা হয়নি। যেমন ওবামাকে ভোট দিতে আফ্রিকান-আমেরিকানরা যত সংখ্যায় উৎসাহ দেখিয়েছিলেন এবারে হিলারিকে সমর্থন জানানোর ব্যাপারে তা দেখাবেন না।
আরও রয়েছ। সংবাদমাধ্যম যা-ই বলে থাক হিলারি নিজে জানিয়েছেন, ইমেল তদন্তের ঘোষণায় তাঁর ক্ষতি হয়েছে। ছানবিন করে শেষপর্যন্ত কিছু না মেলার খবর ভোটের দিনদুয়েক আগে জানানো হলেও সে ক্ষতি মেরামত হয়নি। ক্ষতি হয়েছে আরও অনেক কিছুতেই।
এবার যেমন ‘রুরাল আমেরিকা’র কথা সমীক্ষকদের কান পর্যন্ত পৌঁছয়নি, এটা সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন। স্বীকার করে নিয়েছেন, সেই বড় অংশের শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের কথাও। যাঁরা তাঁদের সমস্ত উদারতার ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছিলেন তুরুপের তাসটি। যার নাম ‘পুরুষ অস্মিতা’। কম্যান্ডার–ইন-চিফ পদে মহিলা? উঁহু, এখন নয়। পরে ভেবে দেখা যাবে। আপাতত যেমন চলছে চলুক।
দেখা যাক, একজন মহিলা প্রেসিডেন্ট পেতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্রকে আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হয়!
এরই মধ্যে অবশ্য রাশিয়ার গোয়েন্দাগিরি বেশ হইচই ফেলে দিয়েছে। রাশিয়া (পুতিন বললেই ভাল শোনায়) নাকি চেয়েছিল, ট্রাম্পকে। তাই এবারে নির্বাচনের আগে বহু তথ্য এবং কৌশল নাকি তারা আগেই হ্যাক করে জেনে গিয়েছিল। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান যেহেতু বিষয়টি ঘোষণা করেছেন, অতএব উড়িয়ে দেওয়া কোনওমতেই যায় না। মার্কিন কংগ্রেসকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতেও বলেছেন তিনি। অতএব পরে আরও কী কী এর থেকে বেরিয়ে আসে, তা দেখার ইচ্ছে রইল। আমেরিকার ভোটে রাশিয়া রিগিং করছে । শুনতেও ভাল লাগে। ব্যাপারটা মানায়ও ভাল। তবে কি না এতদিন পরে! ঠান্ডা যুদ্ধের কালেও হলেও কথা ছিল। তবে কিনা পুতিন সহজ বান্দা নন। ট্রাম্পই বা সহজ হলেন কবে।
তদন্ত করে যদি সত্যিই দেখা যায়, অন্যকিছু নয়, রাশিয়াই বদলে দিয়েছে ভোটের যাবতীয় হিসেবনিকেশ, তবে মিডিয়া যেন একটু স্বস্তি পায়।
তাই তো বলি…..
Leave a Reply