যে কাজটি ট্রাম্প করে চলেছেন
গণতন্ত্রকে খোঁড়া করার চেষ্টা শাসক করবেন না তো কে করবেন! সংবাদমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন সাধারণ মানুষের চোখ খুলে দিলে গদি অসুরক্ষিত মনে হয় শাসকের। আমজনতা যত কম জানতে পারে, ততই ভাল। কারণ ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে। বেগড়বাঁই করে ভোটদানে। অতএব আগে গণমাধ্যমের ঘেউঘেউ বন্ধ কর।
আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ঘোষিত শত্রু’ এখন গণমাধ্যম। এখন গণমাধ্যমের সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছেন।
যদিও আজকাল খবর চেপে রাখা খুব কঠিন। খবরের কাগজে যা দেখা যাবে না তা হইহই করে সোশ্যাল মিডিয়া কাঁপাবে। এটা দিনে দিনে দস্তুর হচ্ছে। এখন সবচেয়ে কঠিন বোধহয় সঠিক খবরের হদিশ পাওয়া। প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন স্যোশ্যাল মিডিয়া তার বহুবর্ণের ছটা নিয়ে যেভাবে চতুর্দিকে দাঁত বের করে হাসছে, তাতে আবারও নতুন কৌশল রচনায় মন দিতে হবে গতানুগতিক সংবাদপত্রকে। যেমন প্রয়োজন হয়েছিল টেলিভিশনের সূচনাকালে।
ট্রাম্পের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের দিন কত লোক হয়েছিল? বিভিন্ন কাগজে তাদের নিজস্ব হিসাব প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেইসব প্রতিবেদন বিশেষ মনঃপূত হয়নি ট্রাম্পের। তাঁর প্রেস সচিব বিবৃতি দিয়েছেন কড়া ভাষায়। কেন ‘কম’ করে দেখানো হল দর্শক সংখ্যা? ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, এভাবে পেছনে লাগলে কিন্তু ফল ভাল হবে না। প্রেসিডেন্টের তরফে আগেই জানানো হয়েছে, লোকসমাগমের বিচারে এটা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। তারপরেও কোনও কোনও সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে, ওবামার শপথে এর চেয়ে বেশি ভিড় হয়েছিল। এমনকী, ট্রাম্পবিরোধী মিছিলে এর চেয়ে বেশি লোক হয়েছিল। মাথা গরম হওয়ারই কথা।
ব্রিগেডের সভায় কত লোক হয়েছিল, এ যেন তা নিয়েই চাপান উতোর। বিরোধীরা দশ বললে শাসকদল বলে একশো। পুলিশ চাপে থাকলে বলে, সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে একশো। আর চাপ না থাকলে বলবে পঁচাত্তর। মোদ্দা বিষয়টা হল, আমার পিছনে কতজন রয়েছেন? শাসক চান তার পিছনে একশো শতাংশ থাকুক। না থাকলেও অন্তত গণমাধ্যম বলুক যে আছে। তা না হলেই সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের উপর আঘাত নেমে আসবে?
গণমাধ্যম কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বিলক্ষণ জানেন ট্রাম্প। তিনি প্রচারে থাকতে ভালওবাসেন। এবং চান বিভিন্ন গণমাধ্যম অষ্টপ্রহর তাঁর গুণগান করে চলুক। যেটা হওয়ার নয়। নিজের কাজকর্মের জন্য বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়ে ইতিমধ্যেই আমেরিকার অগ্রগণ্য দুই সংবাদপত্র ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’, এবং ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’কে সরাসরি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন ট্রাম্প। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে তিনি হাতিয়ার করেছেন সোশ্যাল মিডিয়াকে।
টুইটে তাঁর অভিযোগ, দুটি সংবাদপত্র প্রথম থেকেই তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করছে। তাঁর সম্বন্ধে এতটাই মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস, যে পাঠকদের কাছে তাদের ক্ষমা চাইতে হয়েছে। যদিও আসল ঘটনা তা নয়। নভেম্বরে ওই সংবাদপত্রের তরফে পাঠকদের উদ্দেশে যা বলা হয়েছিল তার উপজীব্য ক্ষমা চাওয়া নয়। তাদের বক্তব্য ছিল, ট্রাম্পের মতো অ-গতানুগতিক একজন প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টিই তাদের ভুল পথে চালিত করেছিল। আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে তাঁর জনভিত্তি কিছু খাটো করে দেখেছিল তারা। ব্যস এটুকুই। একে আর যাইহোক ক্ষমা চাওয়া বলে না।
ট্রাম্পের আরও দাবি, ওই সংবাদপত্রের তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করায় নাকি তাদের প্রচারসংখ্যাতেও নাকি প্রভাব পড়েছে। এসবই তিনি দাবি করছেন টুইটে। যা সম্পূর্ণ অসত্য বলে দাবি করেছে সংবাদপত্রগোষ্ঠী। তাদের পালটা দাবি, নভেম্বরে নির্বাচনের পরে তাদের সার্কুলেশন বেড়েছে লক্ষাধিক।
হোয়াইট হাউসের চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট স্টিফেন ব্যানন তো গণমাধ্যমকে কার্যত হুমকি দিয়ে বসেছেন। তাঁর মতে, গণমাধ্যমই এখন বিরোধীপক্ষ। এখন কিছুদিন তাদের উচিত, মুখ বন্ধ করে শুধু শোনা। মার্কিন প্রশাসনের অন্দরমহল থেকেই যদি এমন কঠিন শব্দ উড়ে আসে তবে তো সেটাকে হাল্কা করে নেওয়া সম্ভব নয়। এই ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে মার্কিন গণমাধ্যম আগে খুব একটা কাজ করেনি। ফলে তারাও এখন কৌশল রচনায় নেমে পড়েছে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিনিধিরা গোলটেবিল বৈঠক করেছেন বিষয়টি আলোচনার জন্য। তাদের কাছে এই ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একরকম অভূতপূর্ব। যখন প্রেসিডেন্ট সরাসরি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ছেন। সোজা চলে যাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানেই তিনি খবরের কাগজের নাম করে দেগে দিচ্ছেন ‘ফেক নিউজে’র তকমা। দাবি করছেন এমন কিছু, যা সত্য নয়।
গোলটেবিলের উপজীব্য একটাই, জোট বাঁধো তৈরি হও। তাদের কাছে শব্দের গুরুত্ব সর্বাধিক। কাজেই, ‘মিথ্যা’র মতো কঠিন শব্দের অভিঘাতকে তারা গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে চায়। সে কারণেই এই ধরনের কথা বলার আগে বিচার বিবেচনার মাপকাঠিটি কঠিন এবং কঠোর করা উচিত বলে তারা মনে করে।
ভাবগতিক থেকে আন্দাজ করা শক্ত নয়, ক্ষমতার মিনারে বসে থাকা মানুষটি সম্পর্কে আরও অজানা তথ্য আগামিদিনে প্রকাশ পেতে চলেছে আমেরিকার গণমাধ্যমে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের কাছেও এটা একটা অ্যাসিড টেস্ট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রকৃত জনভিত্তির আন্দাজ পেতে ব্যর্থ হয়েছিল গণমাধ্যম। তখনও ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়াকে অস্ত্র করে যুদ্ধটা লড়েছিলেন। সেই অস্ত্রটাতেই তিনি শান দিয়ে চলেছেন এযাবৎ।
শুধু শাসকের সেই চাপের কাছেই নয়, যে কোনও চাপের কাছে মাথা না নোয়ানোটাই চ্যালেঞ্জ গণমাধ্যমের কাছে। সেই চ্যালেঞ্জকে সাংবাদিকেরা আজকাল কীভাবে গ্রহণ করছেন, সেটাও দেখার অবকাশ তৈরি হয়েছে। তবে পাল্টা লড়াইয়ের ক্ষেত্রটা সব দেশে সমান নয়। আর এই লড়াইটা যেখানে সাংবাদিকেরা এককাট্টা হয়ে করতে পারছেন, সেখানেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মজবুত হয়েছে।
না পারলে তাঁবেদারির রাস্তাই ধরতে হবে। সেখানে সাংবাদিকতার প্রতিস্পর্ধী দৃঢ়তা বলে আর কিছু থাকবে না। সাংবাদিকের সম্মানও কি সেখানে থাকে!
দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা বস্তুনিষ্ঠ সত্যের সাধনা করে। আর তা করে বলেই তার মাথা উঁচু করে কথা বলার অধিকার জন্মায়। তার দেওয়া তথ্য এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তত্ত্ব প্রকৃত ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত হয় বলেই জনমানসে তৈরি হয় বিশ্বাসযোগ্যতা। সেটাও একদিনের ব্যাপার নয় মোটেই। দিনের পর দিন নিষ্ঠার সাংবাদিকতা দিয়ে তা গড়ে তুলতে হয়।
Leave a Reply